
ঐকমত্যের বৈঠক থেকে তিন দলের ওয়াক আউট
স্বাধীন নির্বাচন কমিশন চায় বিএনপি
- আপলোড সময় : ২৪-০৭-২০২৫ ০৩:৫৪:২৮ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৪-০৭-২০২৫ ০৩:৫৪:২৮ অপরাহ্ন


* সিইসি ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে: আলী রীয়াজ
* নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির একক সিদ্ধান্ত চায় না এনসিপি
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ১৮তম দিনের আলোচনায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং অন্য কমিশনারদের নিয়োগ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলীয় রীয়াজ। গতকাল বুধবার দুপুরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দিনব্যাপী আলোচনা শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা জানান।
আলী রীয়াজ বলেন, বিদ্যমান সংবিধানের ১১৮(১) সংশোধন করে নতুন সংশোধিত প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। সংশোধিত প্রস্তাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আইনে নির্ধারিত সংখ্যক নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন কমিশন থাকবে। তিনি বলেন, স্পিকারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটি বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের প্রধান এবং অন্যান্য কমিশনারদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগ করার উদ্দেশে সংসদে প্রণীত আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ‘ইচ্ছাপত্র’ ও প্রার্থীর সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি আহ্বান করাসহ নিজস্ব উদ্যোগে উপযুক্ত প্রার্থী অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, স্পিকারের নেতৃত্বে বাছাই কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হবেন বিরোধী দলীয় ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা ও প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি হিসেবে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। আলী রীয়াজ জানান, এই কমিটি আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ব্যক্তিদের জীবন বৃত্তান্তগুলো স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই করে, সর্বসম্মতিক্রমে তাদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্ধারিত প্রতিটি পদের বিপরীতে একজন করে নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি তাদেরকে কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন। তিনি জানান, স্পিকারের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সংসদ সচিবালয় এই কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে। বিদায়ী কমিশনের মেয়াদ শেষ হলে অথবা অন্য কোনো কারণে পদ শূন্য হলে পরবর্তী দিন থেকে নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনাররা দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। আলী রীয়াজ আরও বলেন, এছাড়া আজকের আলোচনার পর জাতীয় সংসদ কর্তৃক নির্বাচন কমিশনের ওপর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পৃথক আইন ও আচরণবিধি প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে বিদ্যমান সংবিধানের উপানুচ্ছেদ ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ অপরিবর্তিত থাকবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আজকের আলোচনায় অংশ নেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও এবি পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। বৈঠকে কমিশনের সদস্য হিসেবে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ১৮তম দিনে অংশ নেয় বিএনপি। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা শুধু সংবিধানে উল্লেখ থাকলেই যথেষ্ট নয়, তার কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে উপযুক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, আমরা অতীতে বলে এসেছি যে, প্রতিটি সাংবিধানিক এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জন্য সংবিধানে আলাদা করে নিয়োগ প্রক্রিয়া না এনে, সংশ্লিষ্ট আইনের মাধ্যমে সেই সব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আচরণবিধি নিশ্চিত করতে হবে। তবে নির্বাচন কমিশনের বিষয়টি সংবিধানে আলাদা করে উল্লেখ করা যায়-এই ক্ষেত্রে আমরা একমত। তিনি জানান, সংলাপে সব পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট সিলেকশন কমিটি গঠনের প্রস্তাব চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। এই কমিটিতে থাকবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার (সভাপতি), বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং প্রধান বিচারপতির মনোনীত একজন আপিল বিভাগের বিচারপতি। এই কমিটি নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রার্থী খুঁজে বের করতে একটি অনুসন্ধান প্রক্রিয়া পরিচালনা করবে, যেখানে সিভিল সোসাইটি, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণ নাম জমা দিতে পারবে। সংসদে একটি আইন-প্রণয়ন করে এই অনুসন্ধান বা সার্চ কমিটির কাঠামো নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই সার্চ কমিটি জীবনবৃত্তান্ত যাচাই-বাছাই করে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করবে এবং সেটি সিলেকশন কমিটির কাছে পাঠাবে। কমিটি চাইলে এই তালিকা থেকে অথবা নিজেরা আরও প্রার্থী বিবেচনায় নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে কমিশনারদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠিত ঐক্যকে তিনি স্বাগত জানিয়ে বলেন, এই গঠন প্রক্রিয়া এবং কমিশনের ভবিষ্যৎ কাজের দিক নির্দেশনা নির্ধারণে যে সর্বসম্মত প্রস্তাব এসেছে, তা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ভিত্তি তৈরি করবে।
সংলাপে অংশ নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির একক সিদ্ধান্ত চায় না। তিনি বলেন, বহুদিন ধরে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। অতীতে ফ্যাসিবাদী পদ্ধতিতে একটি আইন করে একচেটিয়াভাবে রাষ্ট্রপতিকে নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। আজ আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, এ প্রক্রিয়াটি আর একক সিদ্ধান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আখতার হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির মনোনীত একজন আপিল বিভাগের বিচারপতির সমন্বয়ে একটি ৫ সদস্যের সিলেকশন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে এবং রাষ্ট্রপতি সেই নাম অনুযায়ী নিয়োগ দিতে বাধ্য থাকবেন। নির্বাচন কমিশনারদের জবাবদিহিতার বিষয়টি নিয়েও আজকের বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে বলেও জানান আখতার হোসেন। তিনি বলেন, আগে কমিশনারদের আচরণ বা ব্যর্থতার জন্য তাদের জবাবদিহিতার কোনো আইনগত কাঠামো ছিল না। আজকের বৈঠকে সেই ঘাটতি পূরণে একটি নতুন আইন-প্রণয়নের প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নিয়োগের বিধি সংবিধানে যুক্ত করতে রাজনৈতিক ঐকমত্যকে ঐতিহাসিক বলে মনে করে বলেছেন, অন্যান্য সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও আমাদের অবস্থান পরিষ্কার এসব বিধানকে সংবিধানে সন্নিবেশ করতে হবে। বিএনপির অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপি চায় এসব প্রতিষ্ঠান আইন দ্বারা পরিচালিত হোক, সংবিধানে না আনলেও চলবে। কিন্তু আইন খুব সহজেই বাতিল বা পরিবর্তনযোগ্য। তাই আমরা বলছি, যদি নিয়োগ কমিটির কাঠামো সংবিধানে যুক্ত না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে যেকোনো সরকার এককভাবে আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা বদলে ফেলতে পারবে। এটি সংস্কার প্রক্রিয়াকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার অভিযোগ এনে এর প্রতিবাদে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ থেকে ওয়াক আউট করেছে সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদ। ১০ মিনিটের ‘প্রতীকী ওয়াক আউট’ করে দল তিনটি। শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সঞ্চালক হিসেবে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজকে কথা বলার অনুরোধ করেন। তিনি সূচনা বক্তব্য দেন। এরপর বক্তব্য দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, অতীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে স্বৈরাচারী শাসকরা যে ধরনের ঘটনাগুলো ঘটাত, তারই ছায়া দেখলাম। স্বৈরাচারে যারা ছিল, তারা এখানে নানান সংকট, ষড়যন্ত্র করবে, সেটা জানি। একজন উপদেষ্টাকে দেখলাম তিনি বলছেন, গতকালের ঘটনা স্বৈরাচারেরা করেছে। এটাকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করাই (এখন) কাজ। আগে স্বৈরাচারী হাসিনা যখন বিপদে পড়ত, এ ধরনের কথা বলত, তার পাশে ১৪ দল বা অন্যরা বসে থাকত। বলত, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সেরকম দেখছি। ঐকমত্যের আলোচনা জরুরি হলেও ওয়াক আউটের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন মন্তব্য করে প্রিন্স বলেন, এ ঘটনার প্রতিবাদ করা ছাড়া এখানে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য ১০ মিনিটের জন্য থাকতে চাই না। এ সময় তাকে সমর্থন জানান জাসদের স্থায়ী কমিটির মুশতাক হোসেন এবং বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ। ওয়াক আউটের পর কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, তিনটি দল প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে যা করেছেন, সেটা নাগরিক হিসেবে, রাজনৈতিক দলের অধিকারের চর্চা হিসেবে স্বাগত জানাই। আমরা মনে করি তাদের বক্তব্যগুলো জাতির সামনে উপস্থাপিত হয়েছে, সরকার বিবেচনা করবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ