ঢাকা , বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫ , ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
টাঙ্গাইলে এনসিপির পদযাত্রা, নিরাপত্তায় ৯ শতাধিক পুলিশ সদস্য সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত মডেল মেঘনার জব্ধকৃত মালামাল ফরেনসিক রিপোর্ট তৈরির আদেশ সারাদেশে নীরবে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী মেলিওডোসিস ওয়ারড্রব ম্যালফাংশনের শিকার হলেন জেনিফার লোপেজ এবার প্রাক্তন স্বামীর ৩০ হাজার কোটির সম্পত্তিতে ‘চোখ’ কারিশমার অক্ষয় কুমারের ফিটনেস রহস্য ফাঁস! বিপাকে রাজকুমার! জারি হলো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাগৃহে জয়ার নতুন সিনেমা সবাইকে কেন সতর্ক করলেন অভিনেত্রী সাদিয়া আয়মান? আবারও রায়হান রাফী ও তমা মির্জার প্রেমে ভাঙন বিএনপির ভরসার কেন্দ্রবিন্দুতে আপসহীন খালেদা জিয়া ডেঙ্গু আতঙ্কে নগরবাসী জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র ৫ আগস্টের মধ্যে জারি করতে হবে : নাহিদ ইসলাম বিয়ামে এসি বিস্ফোরণ নয়, নথি পোড়াতে গিয়ে আগুনে পুড়ে ২ জন নিহত ডিএসসিসির পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রানওয়েতে স্কুলের পারমিশন যারা দিয়েছে তাদের ধরতে হবে-স্বাস্থ্য উপদেষ্টা একই দিনে শহীদ মিনারে সমাবেশ করতে চায় এনসিপি ও ছাত্রদল দেশকে পুনরায় গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন তারেক রহমান-ফখরুল রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ প্রধান বিচারপতির

ডেঙ্গু আতঙ্কে নগরবাসী

  • আপলোড সময় : ২৯-০৭-২০২৫ ০৪:৩৩:৫৫ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৯-০৭-২০২৫ ০৪:৩৩:৫৫ অপরাহ্ন
ডেঙ্গু আতঙ্কে নগরবাসী
মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলেও কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ ২ সিটি কর্পোরেশন ভয়াবহ রূপ নেয়ার পরেও দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রুটিন ওয়ার্কে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১৪ হাজার ৬৯ জন, কেবল জুনেই আক্রান্ত ৫৯৫১ দুই সিটি কর্পোরেশন এক বছরে ১৫৪ কোটি টাকা ব্যয় করলেও মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ দিন নেই, রাত নেই, ঘর কিংবা অফিস, রাস্তাঘাট কিংবা বাজার, মশার দখলে যেন পুরো ঢাকা শহর। ছোট এ প্রাণীর নিঃশব্দ আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নগরজীবন। কোথাও স্বস্তি নেই। দিনের বেলায়ও মশা তাড়াতে ঢাকার অনেক এলাকায় কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের ওষুধ ছিটানো কিংবা স্প্রের কার্যকারিতাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। নগরবাসীর নাভিশ্বাস ওঠানো ডেঙ্গু জ্বরে প্রতি বছরই নাকাল হয় রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দারা। বছরের বিশেষ কিছু সময়ে মশার দৌরাত্ম্যে শহরের চিত্র হয়ে ওঠে উদ্বেগজনক। ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হলে হাসপাতালগুলোর ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ঠাঁইও মেলে না, অন্যদিকে রোগীর ভিড়ে চিকিৎসকদেরও হিমশিম খেতে হয়। ভয়াবহ রূপ নেয়ার পরেও দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকে শুধু রুটিন ওয়ার্কে। চলতি বছরে ঢাকা শহরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১৪ হাজার ৬৯ জন, কেবল জুনেই আক্রান্ত ৫৯৫১ জন। ঢাকায় দুই সিটি কর্পোরেশনে এক বছরে ১৫৪ কোটি টাকা ব্যয় করলেও মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর কারণে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলেও কার্যকর কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, অব্যাহত অবহেলায় পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, বাড়তে পারে প্রাণহানির সংখ্যা। তবুও দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রুটিন ওয়ার্ক মশক নিধন অভিযানে। ফলে প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় ঘরে-বাইরে মশার উৎপাতের সঙ্গে যোগ হয়েছে ডেঙ্গুর আতঙ্ক। সবমিলিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। দিন যত গড়াচ্ছে, দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ততই বাড়ছে। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও। জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদেরা আগেই সতর্ক করে বলেছিলেন, চলতি বছর ডেঙ্গুর পরিস্থিতি নাজুক হতে পারে। এখন বাস্তবচিত্র সেই আশঙ্কাকেই সত্যি করে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকাগুলোতে এখনই বাড়ি বাড়ি গিয়ে উৎস খুঁজে মশার বিস্তার ঠেকাতে হবে। এডিস মশার প্রজননস্থল নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলেও তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৬৯ জন। এর মধ্যে শুধু জুনেই আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৯৫১ জন। জুলাই মাসও উদ্বেগজনক। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আনলে সামনে বিপদের গন্ধ স্পষ্ট। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হচ্ছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তারা বছরজুড়ে মশক নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সিটি কর্তৃপক্ষের ভাষায়, এডিস মশার প্রজননস্থল শনাক্ত ও ধ্বংসে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিশেষ কিছু মৌসুমি কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সভা ও সেমিনারের আয়োজন, প্রচারপত্র বিতরণ, স্বেচ্ছাসেবীদের সম্পৃক্তকরণ ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম। সিটি কর্পোরেশনের দাবি, এসব উদ্যোগের মাধ্যমে নগরবাসীকে ডেঙ্গুর ঝুঁকি ও প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। তবে বাস্তব চিত্র বলছে, এসব কার্যক্রম এখনও কাক্সিক্ষত সুফল আনতে পারেনি। মিরপুরের বাসিন্দা জুয়েল রানা একজন ব্যবসায়ী। তিনি মশার উপদ্রব সম্পর্কে বলেন, ঘরে শান্তি নেই, দোকানে বসেও মশার কামড় খেতে হয়। কয়েল, স্প্রে সব ব্যবহার করছি, কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। রাতে ভালো করে ঘুমানো যাচ্ছে না। গত বছর আমার ছোট ভাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এ বছরও মনে হচ্ছে ভয়াবহ কিছু আসছে। সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম সম্পর্কে তার অভিযোগ, তারা শুধু কথাই বলে, অথচ মাঠে কিছু দেখি না। যে ওষুধ ছিটানোর কথা, সেই লোকদেরও দেখি না। রাজধানীর বনশ্রী এলাকার গৃহিণী রেহানা খাতুন বলেন, বাসায় ছোট বাচ্চা থাকায় ঠিকমতো কয়েল, অ্যারোসল ব্যবহার করতে পারি না। মশার উপদ্রব এত বেশি যে দিনের বেলাতেও মাঝে মাঝে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হয়। বাড়ির বারান্দা, টয়লেট, এমনকি রান্নাঘরেও মশা ভনভন করে। সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রমও মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। কিন্তু তা লোক দেখানো মনে হয়। তারা আসে, ধোঁয়া ছড়িয়ে চলে যায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। আমরা নিজেরাই নিয়মিত ঝাড়ু ও ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে আশপাশ পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি। অথচ চারপাশের ড্রেন বা গলিগুলোতে মশার আড্ডা। এসব দেখার যেন কেউ নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মঞ্জুর হোসেন বাস করেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়। তিনি বলেন, এই শহরে মশাই যেন সবচেয়ে নিরাপদে আছে! দিন-রাত যন্ত্রণা দিচ্ছে, তার সঙ্গে ডেঙ্গুর আতঙ্ক তো আছেই। গত বছর অফিসের তিনজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। সিটি কর্পোরেশন শুধু সেমিনার করে, ব্যানার টানায়, কিন্তু বাস্তবে ওষুধ ছিটানো লোকজন চোখেই পড়ে না। আর যা করে তা লোক দেখানো। এতে কোনো সুফল আসবে না। রাজধানীতে মৌসুম শুরুর আগেই বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রভাব। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক জরিপে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার দুই সিটির ১৩টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের থেকেও বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার আওতাধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীন গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে চালানো প্রাক-বর্ষা জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। সাধারণত এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি ‘ব্রুটো ইনডেক্স’-এর মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর মাত্রা বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। এলাকাগুলো ডেঙ্গুর বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হলো-১২, ২, ৮, ৩৪, ১৩ ও ২২নং ওয়ার্ড। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো-৩১, ৪১, ৩, ৪৬, ৪৭, ৪ ও ২৩নং ওয়ার্ড। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে ১২নং ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডে এডিস মশার ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। পরের অবস্থানে রয়েছে ২, ৮ ও ৩৪নং ওয়ার্ড। এগুলোতে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এছাড়া ১৩ ও ২২নং ওয়ার্ডে ২০ শতাংশ ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩১ ও ৪১নং ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি, ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এছাড়া ৩, ৪৬ ও ৪৭নং ওয়ার্ডে ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ৪ ও ২৩নং ওয়ার্ডে ২০ শতাংশ ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে। মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ১৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বরাদ্দ রাখে প্রায় ১১০ কোটি টাকা। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বরাদ্দ রাখে ৪৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে গত এক বছরে ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তবুও নিয়ন্ত্রণহীন মশা, অতিষ্ঠ নগরবাসী। প্রতি বছর মশা মারতে বাজেট বাড়ায় ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। বাজেট বাড়লেও কমে না মশা, উল্টো মশার উৎপাত প্রতি বছরই যেন বাড়ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ডিএনসিসি মশা নিয়ন্ত্রণে প্রায় ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে। এর মধ্যে কীটনাশক কিনতে ব্যয় ধরা হয় ৬৫ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহন, ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক এবং মশা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ রাখা হয়। একই অর্থবছরে ডিএসসিসি বরাদ্দ রাখে ৪৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক কিনতেই তারা বরাদ্দ রাখে ৪০ কোটি টাকা। এছাড়া ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহনে ব্যয় ধরে তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকা। পাশাপাশি ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক কিনতে বরাদ্দ রাখে আরও ৫০ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশা নিধনে প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এত অর্থ ব্যয় করা হলেও ফলাফল শূন্য, অপ্রতিরোধ্য থাকছে মশা বলছেন নগরবাসী। বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা, শুষ্ক মৌসুমে ধুলার দুর্ভোগ, আর বছরজুড়ে যানজটের ভোগান্তি যেন রাজধানীবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী। এসব ভোগান্তির সঙ্গে মশার উপদ্রবে রীতিমতো অতিষ্ঠ দুই কোটির অধিক জনগণ। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নানা উদ্যোগ, অভিযানসহ নিত্যনতুন কার্যপরিচালনা করেও হার মানতে হচ্ছে মশার কাছে। মশার অত্যাচার থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে কার্যত ব্যর্থ সংস্থা দুটি। বিগত বছরগুলোতে মশা বা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল ঢাকা উত্তর (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। চলতি বছরও গতানুগতিক প্রস্তুতিতে সীমাবদ্ধ রয়েছে তারা। কয়েক বছর আগে মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করেছিল ডিএনসিসি। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন যখন ড্রোন ব্যবহারের সার্বিক দিক নিয়ে আরও বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়, তখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) মশা মারতে অভিনব এক পদ্ধতি ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। তারা মশা মারতে দুই বছর আগে খাল, নালা, ড্রেনসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়ে। ওই সময় ডিএসসিসি মনে করেছিল, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য কাজে লাগিয়ে ব্যাঙগুলো পানিতে ভাসতে থাকা মশার লার্ভা খেয়ে ফেলবে। ফলে সেসব স্থানে মশা আর বংশবিস্তার করতে পারবে না। এছাড়া, জিঙ্গেল বাজিয়েও মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে তারা। এমন নানা উদ্যোগ নিয়েও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নগরবাসীকে মশার অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে পারেনি। দুই বছর আগে মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করেছিল ডিএনসিসি। পরে তারা ডেঙ্গু মোকাবিলায় শহরজুড়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এডিস মশার প্রজননস্থল এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ পরিত্যক্ত পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপ, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত টায়ার, কমোড ও পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এটিও তেমন কাজে আসেনি। নগরবাসীকে মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে গত ১০ বছরে দুই সিটি কর্পোরেশন বাজেটে বরাদ্দ রেখেছিল প্রায় ৮৩০ কোটি টাকা। কিন্তু এত টাকা খরচ করেও নগরবাসীকে মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে পারেনি সিটি কর্পোরেশন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) গত ১০ অর্থবছরে ৫৬০ কোটি টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ দেয় মশক নিধনে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৪ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১১.৯৫ কোটি), ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৩.২৫ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৬.৮৫ কোটি), ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৭.৫০ কোটি), ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৭.৫০ কোটি), ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৯.৩০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫৮ কোটি), ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫০.৫০ কোটি), ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৫ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫১.৫৩ কোটি), ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৬ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫২.৫০ কোটি), ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৪.৫০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৮৭.৫০ কোটি) এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) গত ১০ অর্থবছরে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা মশক নিধনে বরাদ্দ দেয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২.৫০ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১.৫০ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৫.৬০ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৬ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২.৭৫ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০.০২ কোটি টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১.০২ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৮.৮৩ কোটি টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪৪.৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, বর্ষার মৌসুমকে মাথায় রেখে ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা দুটি স্তরে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আমাদের নিয়মিত মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলছে, পাশাপাশি বিশেষ মশক নিধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম এবং জনগণকে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে কাজ পরিচালনা করছি। আমরা যেমন আমাদের দিক থেকে কাজ করে যাচ্ছি, তেমনি নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে বলেন দক্ষিণের প্রশাসক। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, মশার ওষুধ ঠিকমতো ছিটানো হচ্ছে কি না, সেটি আমরা তদারকি করছি। আমাদের কর্মীরা মাঠে আছে, তারা নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি নগরবাসীকেও নিজ নিজ বাসাবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে আমরা আহ্বান জানিয়ে আসছি। কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুবই খারাপ হবে। চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে প্রতিটি বাসায় এডিসের প্রজননস্থল খোঁজা, ধ্বংস করা ও লার্ভা নিধনের ওষুধ ছিটাতে হবে। সিটি কর্পোরেশনকে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বসহকারে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, বিশেষ করে জনসচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই জরুরি।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স