ঢাকা , শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫ , ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
পোরশায় ধর্ষণ মামলার আসামি আবুল হাসান গ্রেফতার কোনো দলের প্রতি সেনাবাহিনীর আলাদা নজর নেই : সেনা সদর সর্দি-জ্বরে জর্জরিত দেশ আগামী নির্বাচন প্রতিটি নাগরিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ: তারেক রহমান দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের সিদ্ধান্ত কিশোরগঞ্জ ভেঙে বাজিতপুরকে জেলায় রূপান্তরের দাবি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় অনুমোদনে চরম অনিয়ম আউটসোর্সিং খাতের নীতিমালা সংশোধনের দাবি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে বদলে যাচ্ছে ট্রেনের সময় কার্যকর ১০ আগস্ট ফেনীতে হাসিনা-নিজাম হাজারীসহ ২২১ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট মৌলভীবাজারে সেপটিক ট্যাংকে নেমে যুবকের মৃত্যু ঢামেকে ভুয়া চিকিৎসক সেজে রোগীর সঙ্গে প্রতারণায় আটক ২ ১০ দিনে বাসার দখল নিতে হবে সরকারি চাকরিজীবীদের থানায় ঢুকে ‘মব’ সৃষ্টি : তিনজন কারাগারে গণতন্ত্র চর্চা করলে সমাজের বৈষম্য হ্রাস পায়-উপদেষ্টা নওগাঁয় হত্যা মামলায় দু’জনের মৃত্যুদণ্ড ও ধর্ষণ মামলায় দু’জনের যাবজ্জীবন নওগাঁ সীমান্ত দিয়ে ১০ জনকে বিএসএফের পুশ ইন সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে জিম্মি ডেসটিনি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাণিজ্য-বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করবে : ঢাকা চেম্বার সার কারখানা চালু রাখতে বন্ধ করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র
* ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া নিয়ে বাড়ছে বিভ্রান্তি * জ্বরের সাথে গলা, হাত-পা ও সারা শরীর ব্যথা * রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো * ১৪ দিনের ব্যবধানে রোগী বেড়েছে ১৮ শতাংশ

সর্দি-জ্বরে জর্জরিত দেশ

  • আপলোড সময় : ০১-০৮-২০২৫ ০৩:১৪:১৫ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০১-০৮-২০২৫ ০৩:১৪:১৫ অপরাহ্ন
সর্দি-জ্বরে জর্জরিত দেশ
সর্দি ও জ্বরে জর্জরিত হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ। যাদের এই সর্দি জ্বর হচ্ছে তাদের গলা, হাত-পা ও সারা শরীর ব্যথা এবং কাশিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। রোগীর ডেঙ্গু নাকি চিকুনগুনিয়া এই নিয়ে বাড়ছে বিভ্রান্তি। জুলাই মাসের প্রথম ১৪ দিনের তুলনায় পরের ১৪ দিনে ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে রোগী ভর্তির হার। ফলে সেবা দিতে গিয়ে চাপে পড়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সাধারণ ভাইরাল ফ্লু হলেও এর সংক্রমণ গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বেশি। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জনসচেতনতা কম থাকায় সংক্রমণ ছড়াচ্ছে দ্রুত।
হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জ্বর নিয়ে আসা রোগীদের বেশিরভাগই করোনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড কিংবা সাধারণ মৌসুমি ভাইরাসজনিত জ্বরে আক্রান্ত। উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে- চার থেকে পাঁচদিন স্থায়ী জ্বর, গলাব্যথা, হালকা কাশি, মাথা ও শরীর ব্যথা, দুর্বলতা এবং কিছু ক্ষেত্রে হালকা শ্বাসকষ্ট। একজন সদস্য আক্রান্ত হওয়ার পর পরিবারের অন্য সদস্যরাও অল্প সময়ের মধ্যে জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক পরিবার থেকেই একই দিনে দুই বা তিনজন রোগী হাসপাতালে আসছেন। উপসর্গ প্রায় সবার ক্ষেত্রেই মিলছে, যার ফলে চিকিৎসকদের ধারণা-এটি ঋতু পরিবর্তনজনিত ভাইরাল সংক্রমণ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগের সম্মিলিত ফল। রাজধানীজুড়ে হঠাৎ করে ভাইরাল জ্বর, সর্দি, কাশি ও ডেঙ্গু উপসর্গে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। জুলাই মাসের প্রথম ১৪ দিনের তুলনায় পরের ১৪ দিনে ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী বেড়েছে গড়ে ১৮ শতাংশেরও বেশি। ফলে সেবা দিতে গিয়ে চাপে পড়েছে সরকারি হাসপাতালগুলো।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের তথ্য বলছে, জুলাইয়ের প্রথম ১৪ দিনে হাসপাতালটির মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮ হাজারের বেশি রোগী। আর ১৪ থেকে ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে চিকিৎসা নিয়েছেন সাড়ে ৯ হাজারের বেশি রোগী। এই ১৪ দিনের ব্যবধানে রোগী বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি। একই সময়ে এই হাসপাতালে করা হয়েছে ৭৫ হাজারের বেশি ভাইরাল জ্বর-সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
এদিকে, রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১১ তলায় ডেঙ্গু কর্নার ঘুরে (গত ২৯ জুলাই) দেখা গেছে, সেখানে ভর্তি রয়েছেন ৩৪ জন রোগী, যাদের মধ্যে ১৪ জন নারী। আর শিশু বিভাগের আটতলার ডেঙ্গু কর্নারে চিকিৎসা নিচ্ছে ১১ জন শিশু। হাসপাতালের তথ্য বলছে- ১ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৪৫ জনে। এর মধ্যে প্রথম ১৪ দিনে ভর্তি ৭২৫ জন এবং পরের ১৪ দিনে ভর্তি হয়েছেন ৮২০ জন। হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য বলছে, সাধারণ ভাইরাল জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ডেঙ্গু মিলিয়ে রোগীর চাপ আগের তুলনায় দ্বিগুণের কাছাকাছি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই হিসাব শুধু সরকারি হাসপাতালের হলেও রোগীর চাপের বড় অংশই চলে যাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে, যাদের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান সামনে আসছে না। এর বাইরেও অসংখ্য রোগী এখন হাসপাতালে না গিয়ে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন, যাদের হিসাব সরকারি কোনো পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না।
এদিকে চিকিৎসক ও ফার্মেসিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকেই হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার সর্দি-জ্বর, গলাব্যথা, কাশি ও দুর্বলতা নিয়ে বাসায় থেকেই সেবা নিচ্ছেন-ফার্মেসির পরামর্শ, পরিচিত চিকিৎসক বা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে। ফলে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা হাসপাতাল পরিসংখ্যানের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগীদের তথ্য বাইরে না আসায় পরিস্থিতির পূর্ণমাত্রা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ছে, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা রুবাইয়া তাসনিম জানান, গত তিনদিন ধরে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা, জ্বর, হালকা কাশি। মাঝে মাঝে জ্বর একটু কমে, আবার বাড়ে। ওষুধ খেলেই কিছু সময়ের জন্য আরাম লাগে। আমার ছোট বোনও জ্বরে ভুগছে। বাসা থেকে বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। পরিচিত এক চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ওষুধ নিচ্ছি। তিনি বলছেন, ভাইরাল জ্বর, কয়েকদিন বিশ্রামে থাকলেই নাকি ভালো হয়ে যাবে।
বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা মো. জাবেদ হোসেন বলেন, প্রথমে আমি আক্রান্ত হই। এর একদিন পর আমার স্ত্রী এবং পরে ছেলে হালকা জ্বরে পড়ে। সবার একই উপসর্গ— জ্বর, কাশি, গলাব্যথা। শরীর খুব দুর্বল লাগছে। হাসপাতালে গেলে সময় আর টাকা দুই-ই বেশি লাগতো, তাই এক আত্মীয় যিনি ডাক্তার, তার পরামর্শে ওষুধ নিচ্ছি। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছে জ্বর কমে যাচ্ছে, আবার শরীর গরম হয়ে যায়। পুরো পরিবারই প্রায় ঘরবন্দি হয়ে আছি এখন।
রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে গিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন প্রতিদিনই এমন বহু রোগী আসছেন, যারা একই পরিবারের দুই বা তিন সদস্যকে নিয়ে এসেছেন। কারও ছেলে বা মেয়ে আগে আক্রান্ত হয়েছে, তার পরদিনই মা-বাবা বা অন্য ভাইবোনও জ্বরে পড়ে যাচ্ছেন। এমন ধারাবাহিক সংক্রমণের ঘটনায় চিকিৎসকরা মনে করছেন, এটি ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো ভাইরাল সংক্রমণ, যার সঙ্গে রয়েছে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভাইরাসের প্রভাব।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শাহাদাত হোসেন (৪২) নামের এক স্কুলশিক্ষক বলেন, আমার এই জ্বরটা চলছে পাঁচদিন ধরে। মাথাব্যথা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, বুক ভার লাগা। প্রথমে আমার স্ত্রী ও মেয়ে, সবশেষে আমি নিজে আক্রান্ত হই। শুরুতে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছি, পরে অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত হাসপাতালে চলে এসেছি। এখানে অনেকের অবস্থাই আমার মতো। সবার মুখে একই কথা— সারছে না, আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. মেহেদী হাসান বলেন, আমরা গত দুই সপ্তাহ ধরে যেটা সবচেয়ে বেশি দেখছি, তা হলো একটা পরিবারের একজন সদস্য প্রথমে আক্রান্ত হচ্ছে। ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ির অন্যরাও একই উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। উপসর্গগুলো প্রায় একই শরীরব্যথা, গলা খুসখুসে ব্যথা, মাঝারি জ্বর, মাথা ভার লাগা এবং কিছু ক্ষেত্রে হালকা কাশি। তিনি বলেন, আমরা গত এক সপ্তাহে এমন অন্তত ১০-১২টি কেস পেয়েছি, যাদের একেক করে পরিবারের একাধিক লোক একসঙ্গে জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। একইসঙ্গে সবাই আক্রান্ত হওয়া এবং উপসর্গ প্রায় একরকম হওয়া- এটি ভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়।
অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ভাইরাল জ্বরের পাশাপাশি ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। তিনি জানান, ডেঙ্গুতে সাধারণত মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পাতলা পায়খানা এবং পেট ব্যথার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে চিকুনগুনিয়ায় শরীরজুড়ে ব্যথার পাশাপাশি বিশেষ করে হাড়ের সন্ধিতে এবং মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। অনেক সময় লালচে র‌্যাশও ওঠে। দুই রোগের উপসর্গ মিলিয়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ না খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, হঠাৎ গরম, আবার বৃষ্টি আবহাওয়ার এমন চরম বৈচিত্র্যের কারণে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই এখন মৌসুমি ভাইরাল জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। তিনি জানান, বন্যাকবলিত অঞ্চলগুলোতে আবার ভিন্ন চিত্র। সেখানে পানিবাহিত রোগ যেমন টাইফয়েড ও পেটের সমস্যা বেশি হচ্ছে। এসব রোগী সাধারণ মৌসুমি জ্বরের তুলনায় একটু বেশি জটিলতায় পড়ছেন। ডা. আবদুল্লাহ আরও বলেন, এই ধরনের ভাইরাল জ্বরে বেশি কিছু করার দরকার নেই। সাধারণ প্যারাসিটামল খেলেই উপসর্গ চলে যায়। অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের কোনো প্রয়োজন নেই, বরং তা ক্ষতিকর হতে পারে।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে আসা বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই জ্বর, গলাব্যথা, কাশি, দুর্বলতা এই চারটি উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। এগুলো সাধারণ ভাইরাল ইনফেকশনের লক্ষণ হলেও পাশাপাশি ডেঙ্গু এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। তিনি বলেন, আমাদের ধারণা, একাধিক ভাইরাস এখন একসঙ্গে মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে। কেউ কেউ প্রাথমিক চিকিৎসা না নিয়েই জটিল অবস্থায় হাসপাতালে আসছেন, এতে ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, চলতি মাসে ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু ও অন্যান্য ভাইরাল সংক্রমণের কারণে রোগীর চাপ গত মাসের তুলনায় অনেক বেড়েছে। প্রতিদিনই নতুন রোগী আসছেন, যাদের কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, কেউ ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সাধারণ ভাইরাল ফ্লুতে ভুগছেন।
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স