
নওগাঁয় আম গাছে ফলন বাড়াতে ব্যবহার হচ্ছে হরমোন


নওগাঁ থেকে আবু বকর সিদ্দিক
আমের রাজ্য হিসেবে ইতোমধ্যে খ্যাতি পেয়েছে নওগাঁ জেলা। গত চার বছর থেকে আমের উৎপাদন কমছে। তবে ফলন বেশি পেতে এবং লাভবান হতে গাছে হরমোন বা টনিক ব্যবহার করছেন চাষিরা। এতে গাছের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির পাশাপাশি আগামীতে উৎপাদন কমবে। এছাড়াও গাছে অতিরিক্ত হরমোন ব্যবহারে মানব শরীরে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়েবে।
জেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে- চলতি বছর জেলায় ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। যা থেকে প্রায় ৪ লাখ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বাণিজ্য হবে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালে ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার টন আম উৎপাদন হয়। ২০২৩ সালে ৩০ হাজার হেক্টর জমি থেকে ৪ লাখ ২৬ হাজার টন উৎপাদন হয়।
বরেন্দ্র এলাকা হিসেবে পরিচিত নওগাঁর সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর ও পত্নীতলা উপজেলার আংশিক এলাকা। পানি স্বল্পতার কারণে এক সময় এসব এলাকায় বৃষ্টি নির্ভর একমাত্র ফসল আমন ধানের ওপর নির্ভর করতে হতো। তবে গত এক যুগের ব্যবধানে বরেন্দ্রের মাঠগুলো এখন সবুজে ছেয়ে গেছে। জমি ইজারা নিয়ে চাষিরা আম বাগান গড়ে তুলছে। আম চাষ লাভজনক হওয়ায় এ অঞ্চলে প্রতি বছরই বাড়ছে বাগানের পরিমাণ। তবে গাছের বয়স হওয়ায় কমেছে আমের উৎপাদন। বাড়তি লাভের আসায় এসব গাছে হরমোন ব্যবহার করছেন চাষীরা। এতে সাময়িক লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিতে পড়ছে এবং গাছ তার উৎপাদন ক্ষমতা হারাচ্ছে। তবে উপাদন বাড়াতে এবং লাভবান হতে চাষীরা না বুঝেই মাত্রাতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার করছেন এতে গাছের দীর্ঘমেয়াদি তার উৎপাদন ক্ষমতা হারাবে।
জানা গেছে- হরমোন উদ্ভিদের মূল শোধনের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। উদ্ভিদ মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহন ও উদ্ভিদের প্রোটিন বা আমিষের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। গ্রীন টনিক প্লাস ফুল ও ফলের দ্রুত বৃদ্ধি ও ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
কৃষকরা জানান, প্রতি বিঘা জমি বছরে ২০-২৫ হাজার টাকায় ইজারা নিতে হয়। এরপর শুধুমাত্র আম উৎপাদনে বছরে খরচ পড়ে অন্তত ৩৫-৪০ হাজার টাকা। যেখানে আমের উৎপাদন হয় প্রায় লক্ষাধিক টাকা। তবে ৭-৮ বছর বয়সি গাছে আমের উৎপাদন কম হলে তাতে হরমোন ব্যবহার করছেন চাষিরা। প্রতি গাছে ৫০ টাকার হরমোনে অন্তত এক হাজার টাকার আম বেশি পাওয়া যায়।
জেলার সাপাহার উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের আম চাষী আবু সাঈদ। গত ৯ বছর আগে নিজের ২০ বিঘা জমিতে আম চাষ শুরু করেন। লাভবান হওয়ায় পর্যায়ক্রমে ১২-১৫ বছরের জন্য জমি ইজারা/বন্ধক নিয়ে বাগানের পরিমাণ এখন ১২০ বিঘা।
চাষি আবু সাঈদ বলেন, কোম্পানি ভেদে হরমোনের এক লিটার বোতলের দাম ২-৪ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় ১৪০-১৫০টি গাছ থাকে। সে হিসেবে এক লিটার হরমোন ৪-৫ বিঘাতে দেয়া সম্ভব। মুকুল আসার ৩ মাস আগে গাছের গোড়ায় ২-৩ মিলি করে হরমোন ব্যবহার করতে হয়। গাছের খাদ্য ও পুষ্টি যোগাতে জমিতে নিয়মিত পানি সেচ দিতে হয়। গাছের বয়স ৭-৮ বছর হয়েছে ফলন কম হচ্ছে সেসব গাছে হরমোন ব্যবহার করতে হচ্ছে। আগে যদি ১০-১২ কেজি আসতো হরমোন দেয়ার পর প্রতি গাছে কমপক্ষে আরো ১০-১৫ কেজি আম বেশি আসবে। সে হিসেবে অন্তত ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা বেশি লাভ আসবে। গত বছর থেকে কিছু গাছে হরমোন ব্যবহার শুরু করেছি। আর একবার হরমোন ব্যবহার করলে প্রতি বছরই ব্যবহার করতে হবে। আর হরমোন ব্যবহার না করলে মুকুলও আসবে না। ইজারা মেয়াদ শেষ হলে জমির মালিককে জমি ফেরত দিতে হবে।
আম চাষী আজগর আলী বলেন, গত ৪ বছর থেকে আমের উৎপাদন কমছে। এ বছর উৎপাদন কম এবং দামও কম। এভাবে চলতে থাকলে বাগান মালিকদের লোকসানের মধ্যে পড়তে হবে। যেসব গাছের বয়স হয়েছে সেখানে হরমোন দিতে বাধ্য হচ্ছি।
আম চাষি সফিউদ্দিন বলেন, গত ৬ বছর থেকে ১৫ বিঘা জমিতে আম চাষ করছি। এরমধ্যে ৯ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে সেখানে আমের চারা রোপণ করে বাগান করা হয়েছে। ১২ বছর পর ইজারার মেয়াদ শেষ হলে জমির মালিককে জমি ফেরত দিতে হবে। গাছে আম কখনো বেশি আসে আবার কখন কম। আবার দেখা যায় ৫০-৬০ শতাংশ মুকুলও আসে। এ অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের লাভ করতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে গাছে হরমোন দিতে হয় যেন আম বেশি আসে এবং লাভবান হতে পারি।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলগুলোতে আমের বাগান সম্প্রসারণ হচ্ছে। তবে কিছু চাষি জমি ইজারা নিয়ে বাগান করেছেন তারা মূলত অধিক মুনাফার আশায় গাছে হরমোন ব্যবহার করছেন। এতে সাময়িক ভাবে তারা ফলন বেশি পেয়ে থাকে তবে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে গাছে ফলনের বিপর্যয় ঘটে। তবে অতিরিক্ত কীটনাশক, বালাইনাশক ও হরমোন ব্যবহার না করতে কৃষকদের সার্বিক পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ