জাতীয় পার্টির মহাসচিব কাজী মো. মামুনূর রশিদ গতকাল বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেছেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রের সংস্কার, বিচার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর ছাত্র-জনতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তার সরকারের মূল লক্ষ্য তিনি নির্ধারণ করেন প্রধান তিনটি স্তম্ভের উপর-সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন।
প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে উল্লেখ করেন ২০২৪ সালের জুলাই মাসে যে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এক নিপীড়নমূলক ও ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে, সেখানে ছাত্র, শ্রমিক ও জনতার অন্যতম আকাক্সক্ষা ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার। এই আকাক্সক্ষা পূরণে তার সরকার একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করে এবং কমিশনগুলোর সুপারিশ অনুসারে বিভিন্ন সেক্টরে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে। তার ভাষ্যমতে, ইতোমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অন্যান্য সংস্কার পরিকল্পনা এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আরও জানান, জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের মাধ্যমে ৩০টিরও অধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে মোট ১৬৬টি সুপারিশ প্রস্তুত করা হয়। এর মধ্যে ১৯টির বেশি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে, যার ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে ঐতিহাসিক ‘জুলাই ঘোষণা’। প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, এই ঘোষণাপত্র ভবিষ্যতে দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার একটি স্মরণীয় দলিল হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
সংস্কার বিষয়ক অর্জন তুলে ধরার সময় তিনি সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং ঐক্যমত কমিশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের রাষ্ট্রকে এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে যেন ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ ও কোটা নির্ভরতার কোনও ছায়া পর্যন্ত যাতে না পড়ে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, এমন একটি রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা হবে যা কোটা নির্ভরতা বা কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার উদ্ভব ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে তা প্রতিরোধ করার সক্ষমতা রাখবে।
এরপরই তিনি বলেন, ‘এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা।’ সেটা হলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন প্রদান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি নির্বাচন কমিশনার বরাবর চিঠি পাঠিয়ে আগামী রমজানের পূর্বে তথা ফেব্রুয়ারি-২০২৬ এর মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তরুণ ও নতুন ভোটাদেরকে আগামী নির্বাচনকে উৎসব হিসেবে গণ্য করে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আহ্বান জানান।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব কাজী মামুন বিবৃতিতে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের গঠন ও তার সদস্যদের পেছনের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ সদস্যই প্রধান উপদেষ্টার নিজস্ব প্রতিষ্ঠিত বা পরিচালিত এনজিওর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি অথবা তার সহযোগী বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত। এটি যে স্বজনপ্রীতি এবং ‘আত্মীয় কোটার’ একটি প্রতিফলন, সে বিষয়ে কোনো দ্বিধা থাকার সুযোগ নেই। বৈষম্য ও কোটা আন্দোলনের ফলে ফ্যাসিবাদী সরকার উৎখাত করে গঠিত সরকার নিজেরাই কোটা নির্ভর নিয়োগের মাধ্যমে প্রশাসন সাজিয়েছে, সেটি নৈতিকতা বিরোধিতার এবং ব্যক্তি শঠতার এক নিকৃষ্ট উদাহরণ। এর মাধ্যমে ড. মুহম্মদ ইউনুস প্রমান করে দিলেন কোটাবিরোধী আন্দোলনটি ছিল তার মেটিক্যুলাস ডিজাইন নামের এমন এক হ্যামিলনের বাঁশি যার মাধ্যমে তিনি যুব, তরুণ, কিশোর এসনকি কোমলমতি শিশুদেরও বিভ্রান্ত করে পক্ষান্তরে দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছেন।
কাজী মামুন বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে দৃপ্ত উচ্চারণ করলেও গত এক বছরে বাস্তবতা হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। সাংবাদিক নির্যাতন, স্ট্যান্ড রিলিজ, হুমকি ও হয়রানি যেন এক নিত্যনৈমিত্তিক চিত্রে পরিণত হয়েছে। শুধু ব্যক্তি সাংবাদিকই নন, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকেও ভেঙে দিয়ে সংবাদপত্র দখল করে তা প্রেসার গ্রুপের কার্যক্রম হিসেবে বৈধতা প্রদানের মতো নিকৃষ্ট ঘটনার জন্ম হয়েছে এই অন্তর্তীকালীন সরকারের সরাসরি প্রশ্রয়েই। বাক স্বাধীনতা হরণের এমন এক দানবীয় নজির বহু যুগ ধরে ড. ইউনূসের নামকে বাংলার ঘরে-ঘরে এক আতংকজনক প্রতিকৃতি হিসেবে মানুষের বিবেক টোকা দেবে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও এমন বিভৎষতা জাতি আর কখনো দেখেনি।
বিবৃতিতে কাজী মামুন আরো বলেন, মানবাধিকার পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও, বাস্তবে তা কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত সহিংসতা, হুমকি এবং বৈষম্যের শিকার হলেও রাষ্ট্রের তরফ থেকে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি স্পষ্ট।
গত বছরের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের মাটিতে ধর্মীয় উগ্রবাদ, ধর্মীয় উন্মাদনা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বারবার আল-কায়েদাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাজার হাজার পতাকা পত-পত করে উড়েছে। মালেশিয়ায় বাংলাদেশিদের আইসিস-এর সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাকিস্তানেও বেশকিছু বাংলাদেশিকে সামরিক অভিযানে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে হত্যা করা হয়েছে। মেদ্দাকথা, পৃথিবীজুড়ে বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী মদদদাতা রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে নানা প্রমাণাদি হাজির করা হলেও ইউনূস এবং তার পরিষদ মুচকি হেঁসে বলেছেন-‘এসব মিথ্যে’। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে এমন গুরুতর বিষয় নিয়ে শিশুদের চড়ুইভাতি খেলার মতো কাজ কারবার আখেরে বাংলাদেশকে কোন্ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে? বাংলাদেশের পাসপোর্টে এখন ভিসা পাওয়া সোনার-হরিণ। ইউনূসের এই ‘অবদান’ আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিভাবে স্মরণ করবে এটা কি প্রধান উপদেষ্টা কখনো ভেবেছেন?
বিদেশি বিনিয়োগ আনার কথা বারবার বলা হলেও, বাস্তবে তা অলীক গল্পে পরিণত হয়েছে। বহু বৈঠক, সেমিনার, বিদেশ সফর আর বিপুল ব্যয়ে আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলনগুলো মূলত জনগণের করের টাকায় বিলাসিতা ও আত্মপ্রচারের আয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস-প্রবাসীরা-যথাযথ মর্যাদা থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছেন। বিমান টিকিটের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি, বিমানবন্দরে হয়রানি ও প্রবাসী সেবার দুর্দশা তাদেরকে রাষ্ট্রের প্রতি বিমুখ করে তুলছে।
শিল্প ও কলকারখানার মালিকরা ক্রমশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন। ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় এলসি খোলা যাচ্ছে না, ফলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে বহু প্রতিষ্ঠান শ্রমিক ছাঁটাইয়ে বাধ্য হচ্ছে। অথচ এই পরিস্থিতিতেও সরকার দাবি করছে যে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে, যার ফলে শ্রমিকদের সময়মত বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের ওপর ক্রমাগত চাপ, মব কন্ট্রোল, চাঁদাবাজির অভিশাপ এবং প্রশাসনিক হয়রানির ফলে দেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। সরকার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ দমনের বিপরীতে উল্টো ব্যবসায়ীদের নানাভাবে হয়রানি করছে যেন সরকার উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন - থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া এমনকি ভারতেও ব্যবসায়ীদেরকে ‘সিআইপি’ মর্যাদা দিলেও আমাদের এখানে ব্যবসায়ীদেরকে সরকার প্রতিপক্ষ হিসেবেই গন্য করে আসছে বিগত এক বছরে।
প্রধান উপদেষ্টা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর কথা বললেও, নৃশংসভাবে পুলিশ সদস্যদের হত্যা ও থানাগুলোতে সৃষ্ট সহিংসতার বিচার কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত থেকে গেছে। সেভেন পয়েন্ট সিক্স এমএম বুলেটকে ব্যবহার করেছিল-এই মৌলিক প্রশ্নেরও উত্তর এখনো জাতির সামনে উপস্থাপিত হয়নি। যারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে জীবন দিয়েছেন, তাদের জন্য ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা না করে কেবলমাত্র একটি পক্ষকে খুশি করার মনোভাব গণতন্ত্রের চরম পরিপন্থী।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে পারেননি প্রধান উপদেষ্টা-অথবা এটা করার ইচ্ছাও তার নেই। রাজনৈতিক দল ও জনগণের সামনে সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ক্রমাগত দিয়েই যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দিবো, দিচ্ছি টাইপের শব্দের ব্যবহার কোনোভাবেই একজন প্রতিশ্রুতিশীল, দায়িত্ববান মানুষের আচরণ প্রকাশ করে না বরং এই ধরনের শব্দের ব্যবহার জনগণের সাথে প্রতারণার শামিল।
এক বছর আগেও মুহাম্মদ ইউনূস এই জাতির কাছে ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আর আজ তার নিজের ভুলেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক, সেই অবস্থান থেকে খসে পড়ে- নোবেল বিজয়ী এই ব্যক্তি পরিণত হয়েছেন ‘গণশত্রু’-তে। মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী হয় তার কর্মের কারণে। চিরকালের জন্য ঘৃণিতও হয় তার দুষ্কর্মের ফলে। শেখ হাসিনার পনেরো বছর নিঃসন্দেহে ছিল এক বিভীষিকাময় দুঃশাসন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিকে এর চেয়েও আরো অনেক বেশি দানবীয়-ফ্যাসিবাদের স্বাদ চাখালেন-মাত্র এক বছরে। হয়তো এই কলংকের দাগ তার কপাল থেকে মুছে যাওয়ার আগেই ইউনূসের জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। আমরাও আর কখনো বিশ্বে মাথা উঁচু করে বলতে পারবো না - আমাদেরও এক নোবেল বিজয়ী ইউনূস ছিলেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

ড. ইউনূস জাতিকে দানবীয়-ফ্যাসিবাদের স্বাদ চাখালেন মাত্র এক বছরে-কাজী মামুন
- আপলোড সময় : ০৭-০৮-২০২৫ ০৬:২৬:০৯ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৭-০৮-২০২৫ ০৬:২৬:০৯ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ