তুরাগ থেকে মনির হোসেন জীবন
রাজধানীর অভিজাত এলাকা হলো উত্তরা মডেল টাউন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তুরাগ ও উত্তরাসহ ঢাকা-১৮ আসনের বিভিন্ন এলাকায় নীরবে চলছে দখলবাজি ও চাঁদাবাজী। ছয়টি থানা এলাকা ঘিরে এক শ্রেণির চাঁদাবাজ, ধান্দাবাজ, দলবাজ ও সমাজের একশ্রেণির সুবিধাবাদীরা আস্তানা গড়ে তুলেছে। এছাড়া উত্তরা, বিমানবন্দর ও তুরাগে ছিনতাই, ডাকাতি, মদ, জুয়া, মদের বার, নামমাত্র ক্লাব, অসামাজিক কার্যকলাপসহ বিভিন্ন অপরাধ দন দিন বেড়েই চলেছে।
সূত্র জানায়, প্রতিদিন ছয়টি থানা এলাকায় কয়েক কোটি টাকা চাঁদাবাজির মতো ঘটনা ঘটে থাকে। তাহলে জনমনে প্রশ্ন জাগে, এত টাকা যায় কোথায়? কারা খায় এই বিপুল পরিমাণ টাকা। কে কত পরিমাণ ভাগ বাটোয়ারার টাকা অংশ পায়, কেবল এটিই এখন দেখার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব চাঁদাবাজদের খুঁটির জোর কোথায়! কে তাদের আশ্রয় ও শেল্টারদাতা। সাধারণ মানুষের মনে এমন প্রশ্ন; তাহলে তাদের আসল গডফাদার কে? কি তার পরিচয়! গতকাল বুধবার সকালে তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, উত্তরা বিভাগে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির বড় একটা খাত হলো উত্তরায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা বিভিন্ন নামসর্বস্ব ক্লাব কিংবা মদের বার, ফ্ল্যাট বাসায় জুয়ার স্পট, উত্তরা সোনার গাঁও জনপথ সড়কের ১১, ১৩ নম্বর সেক্টরের কাঁচা বাজার, বিশাল ফার্নিচার মার্কেট, উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, তুরাগের (ডিয়াবাড়ি) বিআরটিএ অফিস, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন ফুটপাত, আব্দুল্লাহপুর মাছের আড়ৎ, কামার পাড়া ও স্লুইস গেইট কাঁচা বাজার, তুরাগের ১২নং সেক্টর (খালপাড়) রুপায়ন সিটি ও খালপাড় বাজারের সামনের ফুটপাত, সোনার গাঁও জনপদ সড়কের উভয় পাশে সরকারি পরিত্যক্ত রাজউকের জমির ওপর গড়ে উঠা অবৈধ গাড়ির চাকার দোকান পাট, বড় বড় দু’টি ভাঙারির দোকান, উত্তরার কার হাউজ, (গাড়ি বেচাকেনার বিশাল হাট), নার্সারি দোকান, অবৈধ বালুর ট্রাক স্ট্যান্ড, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস সংলগ্ন রাজউকের জমির ওপর একাধিক খাবার হোটেল, সেলুন, চা পানের দোকানপাট, চোরাই তেলের দোকান, লেগুনা ও কাভার্ডভ্যান স্ট্যান্ড, রেলের জায়গায় উপর অবৈধ দোকানপাটসহ হাউজ বিল্ডিং থেকে খালপাড় হয়ে ডিয়াবাড়ি পর্যন্ত লেগুনাস্ট্যান্ড, কয়েকশ অবৈধ রিকসার গ্যারেজ, গ্যাসের বোতল বিক্রির দোকান, মেট্রোরেল স্টেশনের আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ দোকানপাট, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, খাবারের দোকান, ট্রাকস্ট্যান্ড, দলিপাড়া পাকার মাথা থেকে শুরু করে বাউনিয়া বটতলা হয়ে ইসিবি পর্যন্ত লেগুনাস্ট্যান্ড, আজমপুর, আব্দুল্লাহ হতে উত্তরখান মাজার, মৈনারটেক, দক্ষিণ খান, আশকোনা পর্যন্ত লেগুনাস্ট্যান্ডগুলো টাকার তোলার মূল উৎস বা খাত। এছাড়া কামারপাড়া, রানাভোলা, নয়ানগর ও মেট্রোরেল এলাকায় অবাদে কয়েক হাজার লেগুনা গাড়ি এবং হাজার হাজার অটোরিকশা মাসিক মাসোহারা (জিপি’)র ভিত্তিতে প্রকাশ্যে চলাচল করছে। উত্তরা বিভাগের ট্রাক পুলিশ মাঝ মাঝে লোক দেখানো অভিযান চালায়। তার মধ্যে তুরাগের ধউর, কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুর, হাউজ বিল্ডিং, জসিমউদদীন রোড, ১১, ১২,১৭ ও ১৮নং সেক্টর, খালপাড়, ডিয়াবাড়ি মেট্রোরেল ও পঞ্চবটী এলাকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উত্তরা শহরে ৮/১০টি মদের বার ও সীসার বার রয়েছে। সাবেক মহানগর উত্তর যুবলীগের প্রভাবশালী এক নেতা, আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা, কতিপয় সিনিয়র সাংবাদিক, শিল্পপতি, কোটিপতি ব্যবসায়ী এই অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত। এসব বারে, ফ্ল্যাট ও ক্লাবে দিবারাত্রি জুয়ার আসর বসে। তার মধ্যে উত্তরা ১৩ নং সেক্টর অবস্থিত রয়্যাল ক্লাব, বাংলাদেশ ক্লাব, এভিয়েশন ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, অসংখ্য নামি-দামি রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারসহ রাতভর জুয়ার আসর চলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব জায়গায় নামি-দামি কল গার্ল, সুন্দরী তরুণী, নৃত্য শিল্পী, সমাজের উচ্চবিত্ত জুয়াড়ি, শিল্পপতি ও কোটিপতি ব্যক্তিরা নিয়মিতভাবে ভিড় জমান এবং মোটা অঙ্কের টাকার বাজি ধরা হয়। ক্লাবগুলোকে ঘিরে প্রায় সময় বহিরাগতদের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেছে, যা এলাকার নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।
স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে অবগত থাকলেও রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সুশীল সমাজ।
অপরদিকে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)’র পরিত্যক্ত খালি জায়গাগুলোতে হাজার হাজার অবৈধ স্থাপনা বসতি রাতারাতি গড়ে উঠেছে। এসব খাত থেকে রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, বিআরটির কর্মকর্তা, পাসপোর্ট অফিসকে ঘিরে এক শ্রেণির দালাল চক্রের বিশাল সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা অবৈধ ভাবে কৌশলে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে জানিয়েছে।
একাধিক নির্ভরশীল সূত্র জানান, উত্তরা বিভাগের ৬টি থানা উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব, উত্তর খান, দক্ষিণখান, বিমানবন্দর ও তুরাগ থানা এলাকায় সরকার দলীয় পরিচয়ে এক শ্রেণির চাঁদাবাজদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। উত্তরা ১৬নং সেক্টরসহ তুরাগ থানা মেট্রোরেল স্টেশনের পশ্চিম পাশে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর প্রায় ৩ বিঘা সরকারি পরিত্যক্ত জমি কৌশলে জবরদখল করে সেখানে অবৈধভাবে বিশাল একটি বালুর ট্রাক স্ট্যান্ড গড়ে তুলেছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল। এই ট্রাক স্ট্যান্ড প্রায় ৬০/৬৫ টি ট্রাক রয়েছে। এছাড়া খালপাড় পুরাতন ট্রাক স্ট্যান্ডে ২০/২৫ ট্রাক রয়েছে। কোন্দল ও মানাবিধ সমস্যার কারণে আজ উত্তরা ট্রাক স্ট্যান্ডে দুই ভাগে বিভক্ত। একটি গ্রুপ হলো বরিশাল গ্রুপ, অপরটি স্থানীয় গ্রুপ। তবে, বরিশাল গ্রুপে ট্রাকের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। তাই তাদের শক্তিও বেশি।
বালু ব্যবসায়ীরা জানান, পেশীশক্তি আর ক্ষমতার বলে ট্রাক স্ট্যান্ডের সভাপতি হলেন মো. মনছুর নামে এক শ্রমিক দলের নেতা। তিনি উত্তরা পশ্চিম থানা জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সভাপতি দাবিদার। মুনছুর ও তার সাঙ্গপাঙ্গ এবং সহকর্মীরা দখলে নেতৃত্ব দিচ্ছে ট্রাক স্ট্যান্ড। এছাড়া মঞ্জু খাঁ, রবিউল ইসলাম শুক্কুর, শ্রমিক ইউনিয়নর সাধারণ সম্পাদক মো. রানা ও শেখ লেবু গংরা। এই প্রভাবশালী চক্রটি প্রতিটি ট্রাক থেকে মাসিক ২/৩ হাজার টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ এই বিশাল জমির মালিক রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ বলছে, গত ১৮ এপ্রিল, ২০২৫ দুপুরে উত্তরার ৫ নং সেক্টর ৬ /এ নং সড়কের ১৩ নং বাড়ি বায়োটেক কর্পোরেশন নামের একটি মেডিকেটেড কসমেটিকস প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সমন্বয়ক’ পরিচয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা চাঁদার দাবিতে ভাঙচুর-লুটপাট এবং অপহরণের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে ঘটনার খবর পেয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মো. রিয়াজুল ইসলামকে উদ্ধারসহ দুই জনকে গ্রেফতার করে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। পুলিশ আরো জানান, আটককৃতরা হলো- কাজী জোবায়ের ও আবির হাসান। ইতিপূর্বে কাজী জোবায়ের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত দু’জনসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ এবং ২ থেকে ৩ জনকে অজ্ঞাত নামা আসামি করে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা রুজু করা হয়।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ১২ জুলাই ২০২৫ ইং দুপুরে ও বিকেলে উত্তরা ১০ নং সেক্টর সংলগ্ন স্লুইচ গেট এলাকার ফলের আড়ৎ হতে বিএনপি’র বহিঃস্কৃত নেতা চাঁদাবাজ মিলনসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তুরাগ-উত্তরার (দিয়াবাড়ি আর্মি ক্যাম্প)’র সেনা সদস্যরা। আটককৃত ব্যক্তিরা হলো মো. মিলন, মো. সেলিম রানা, মো. সাইদুল ইসলাম, মো. কাজিম উদ্দিন ও মো. আব্দুর রহিম মান্নান। পরবর্তীতে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদেরকে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া গত ৪ আগষ্ট ২০২৫ ইং তারিখ দুপুরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পূর্বাচল আর্মি ক্যাম্পের একটি টহল দল খিলক্ষেত মধ্যপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ মাসুদ রানা (৩৫) কে আটক করে। এসময় তার নিকট থেকে চাঁদা আদায়ের (দুই লাখ ত্রিশ হাজার) টাকা ও ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার মূলে জব্দ করা হয়।
সূত্র জানিয়েছে, গত (৩ আগস্ট,২০২৫) দিবাগত রাতে তিন যুবককে ব্যক্তিগত টর্চার সেলে বন্দি করে নির্যাতন চালিয়ে তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন এই শীর্ষ সন্ত্রাসী। ইতিপূর্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক চাঁদাবাজ মিলন, মাসুদ রানা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম, তুরাগ ও খিলক্ষেত থানাসহ বিভিন্ন থানায় চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসী এবং রাজনৈতিক মামলা রয়েছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
