রাজধানীর শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের ২৪ জন নারী শিক্ষকসহ ২৫ জন শিক্ষকের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। নন-এমপিও পদের স্থায়ী ১৭ জনসহ মোট ২৫ জন শিক্ষক এই কলেজে ৮ থেকে ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন। তারা সবাই এখন চাকরি হারানোর আতঙ্কে আছেন।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি জাকির হোসেন কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নানা অজুহাতে তিনি শিক্ষকদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন যেকোনও সময় তাদের চাকরিচ্যুত করা হতে পারে। চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এসব শিক্ষককে নতুন করে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে দুই দফা বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। প্রথম দফায় গত ২৫ মার্চ ১৪ জন শিক্ষককে এবং দ্বিতীয় দফায় গত ২৭ জুন একটি জাতীয় পত্রিকায় ৪৪ জন শিক্ষককে খণ্ডকালীন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।
ভুক্তভোগী শিক্ষকদের অভিযোগ, ২৫ জন শিক্ষককে প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়েছে খণ্ডকালীন নিয়োগ পেতে আবেদন করতে হবে। কারণ, তাদের নিয়োগ আগে বৈধ ছিল না। অথচ তারা স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন বলে দাবি করেন শিক্ষকরা। তাদের মধ্যে ১৭ জন নিয়মিত বেতন-ভাতা পান। আর বাকিরা অস্থায়ী ভিত্তিতে খণ্ডকালীন হিসেবে বেতন-ভাতা পেয়ে আসছেন।
দ্বিতীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর দিন গত ২৮ জুন হোয়াটসঅ্যাপে নোটিশ পাঠানো হয় ২৫ জন শিক্ষককে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাকসুদা বেগমের পাঠানো নোটিশে এই শিক্ষকদের উদ্দেশ করে বলা হয়, ‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শাখার নন-এমপিও খণ্ডকালীন শিক্ষকদের জানানো যাচ্ছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) গত ২৭ মে’র তদন্ত রিপোর্টের আলোকে সায়নিকা আক্তার, গুলশান আরা আহমেদ, সালমা বেগম, মেহেনাজ নাইয়ারা, রেখা মণ্ডল দীনা, উর্মি নাজনীন, মাজেদা খানম, তাহমিনা বেগম, প্রীতিকা রাণী দাস, বীনা আক্তার, সোমা রাণী চন্দ, ঝর্ণা রাণী মণ্ডল, সুমি আক্তার, জোছনা আক্তার, মো. জহুরুল ইসলাম, মৌসুমি আক্তার, সামিয়া আক্তার মৌ, জাকিয়া আক্তার, সামিনা আফরোজ, মনিরা শারমিন, আয়েশা সিদ্দিকা, খাদিজা আক্তার, আলেয়া আক্তার, রাজিয়া সুলতানার নিয়োগ ও স্থায়ী করার বিষয়টিকে অবৈধ বলেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর। নোটিশে সবাইকে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে আবেদন করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যক্ষ রাসেল মাহমুদ এই নোটিশের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি গত ২৪ জুলাই তারিখ দিয়ে ২৫ জন শিক্ষককে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে আবেদন করতে ৩০ জুলাই আবার চিঠি দিয়েছেন।
ভুক্তভোগী একজন সহকারী শিক্ষক (স্থায়ী) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যে ২৫ জন শিক্ষক নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, তাদের খণ্ডকালীন হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার এই প্রক্রিয়া একটি পাতানো ফাঁদ। কারণ, স্থায়ী শিক্ষকদের নতুন করে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারলে পরে সবাইকে ধীরে ধীরে সহজেই চাকরিচ্যুত করা যাবে। এর প্রতিকার পেতে আমরা গত ৩০ জুলাই ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি। শুধু এই শিক্ষক নন, চাকরি হারানোর ভয়ে ভুক্তভোগী কোনও শিক্ষকই নাম প্রকাশ করতে চান না।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে ১০ জন শিক্ষকের সই করা লিখিত অভিযোগে বলা হয়, আমরা শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের নন-এমপিও স্থায়ী শিক্ষক (প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে) সর্বনিম্ন আট বছর এবং সর্বোচ্চ ১৬ যাবৎ কর্মরত রয়েছি। প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অ্যাডহক কমিটির সভাপতি জাকির হোসেন কামাল দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নানা অজুহাতে শিক্ষকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন যে তাদের চাকরিচ্যুত করা হতে পারে। এ লক্ষ্যে গত ২৫ মার্চ ১৪ জন শিক্ষক এবং ২৭ জুন ৪৪ জন খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাকসুদা বেগমকে দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজের মাধ্যমে ২৫ জন নন-এমপিও স্থায়ী শিক্ষককে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া মৌখিকভাবে আবার আবেদন করার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকেন। এতে শিক্ষকরা ভীত হয়ে পড়েছেন। কারণ গত ১ জুন ঈদুল আজহার ছুটির মধ্যে গভর্নিং বডির (জিবি) বৈঠক করে ১৩ বছর ধরে চাকরিরত নন-এমপিও স্থায়ী শিক্ষক আকলিমা আক্তারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কোনও ধরনের নোটিশ ছাড়াই তাকে বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া একই দিনে রাজিব দাস নামে আরেকজন শিক্ষকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গত ২৫ জুলাই সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত অধ্যক্ষ রাসেল মাহমুদ খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের জন্য লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেন। শিক্ষকদের অনেকেই বুঝতে না পেরে পরীক্ষায় অংশ নেন। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ২৫ জন নন-এমপিও শিক্ষকদের মধ্যে ১৪ জন পরীক্ষায় অংশ নেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের বেতনের সঙ্গে সংযুক্ত সব সুযোগ সুবিধা প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়েটি অবসর ও কল্যাণ ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
শিক্ষকরা জানান, জুলাই মাস থেকে তাদের বেতন বন্ধ রাখা হয়েছে। যে ১০ জন শিক্ষক অধ্যক্ষের নেওয়া পরীক্ষায় অংশ নেননি তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অ্যাডহক কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধি লুৎফুন্নাহার চৌধুরী তুলি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডকে বিষয়টি অবহিত করেন। এছাড়া তিনি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ঢাকা মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং হাইকোর্টে মামলা করেন।
অভিযোগের বিষয়ে শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যক্ষ রাসেল মাহমুদ হাসান বলেন, আমি নতুন এসেছি। আমার দায়িত্ব পাওয়ার আগেই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে আসলে বিস্তারিত জানতে পারবেন, সেক্ষেত্রে গ্যাপ থাকবে না। তবে শিক্ষকরা জানিয়েছেন, খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্র ইস্যু করেছেন বর্তমান অধ্যক্ষ। তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য ২৫ জন শিক্ষককে চিঠিও দিয়েছেন।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি জাকির হোসেন কামাল বলেন, এসব শিক্ষক যখন নিয়োগ পেয়েছেন, সে সময়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কোনও আদেশ আছে কিনা, সেটা দেখেন। নিয়োগ কীভাবে পেলেন এটুকু দেখেন। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) যে নির্দেশনা এসেছে সে অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে। ডিআইএ তাদের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় এবং এমপিও নীতিমালায় খণ্ডকালীন কোনও শিক্ষকের পদ নেই এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের কোনও বিধি নেই। শেরেবাংলা কলেজের গভর্নিং বডির রেজুলেশন যাচাইয়ে দেখা যায়, খণ্ডকালীন কর্মরত কয়েকজন শিক্ষকের নিয়োগ স্থায়ী করা হয়েছে। যেহেতু খণ্ডকালীন শিক্ষকদের কোনও বিধি নেই, সেহেতু কোন বিধির পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি স্থায়ী করা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। যতক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন থাকবে, ততক্ষণ খণ্ডকালীন শিক্ষক কর্মরত থাকবেন। ‘ডিআইএ নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা না করে বোধগম্য নয় বলেছে’ এমন প্রশ্নের জবাবে সভাপতি জাকির হোসেন কামাল বলেন, আরও প্রতিবেদন আছে। তাহলে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই প্রতারণা করা হয়েছে। তবে নিয়োগ সঠিক দাবি করে নিয়োগকালীন সময়ের অধ্যক্ষ (সাবেক) মনোয়ার হোসেন বলেন, ডিআইএ’র প্রতিবেদনের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে বর্তমান কর্তৃপক্ষ। নন-এমপিও পদে শিক্ষক নিয়োগে গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত রয়েছে। আর ডিআইএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ডিআইএ’র প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, গভর্নিং বডির নিয়োগই চূড়ান্ত। গণহারে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ থেকে বিরত থাকার কথাও বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। অথচ স্থায়ী ও খণ্ডকালীন নিয়োগ পাওয়া কর্মরত ২৫ জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে, খণ্ডকালীন নতুন নিয়োগ দেওয়ার জন্য ২৫ জন শিক্ষককে বর্তমান অধ্যক্ষ চিঠি দিয়েছেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়
নারীসহ ২৫ শিক্ষকের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ
- আপলোড সময় : ১৬-০৮-২০২৫ ০৭:০৪:০৩ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৬-০৮-২০২৫ ০৭:০৪:০৩ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ