মো: আবু সাঈদ
আমেরিকার প্রধান অস্ত্র ডলারের একক আধিপত্যবাদ ভাংতেই নতুন জোট ব্রিকসের যাত্রা মনে করেন অনেকেই। আমিও তাই স্বীকার করি। অর্থনৈতিক শক্তিকে সুরক্ষা দিতে এই নতুন জোটের মধ্যে এখন সামরিক জোট গঠনেরও কথা শোনা যায়। ন্যাটো জোটের আদলে দক্ষিন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটা সামরিক জোট গঠন হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমেরিকার মত তারা আক্রমনে না গেলেও প্রতিরক্ষা তো করতে পারবে? কারণ এ অঞ্চলে কিছু ছোট ছোট দেশ আছে তাদের মূলত সামরিক বাহিনী আছে নামে। তারা সম্ভব্য শত্রু বা প্রতিবেশীর সাথে বিবাদ শুরু হলে এক দুই দিনেও যুদ্ধ করে ঠিকে থাকতে পারবে না। অনেকের আবার সামরিক বাহিনীও নেই! যাই হোক এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে শুল্ক যুদ্ধ শুরু করেছেন তা শুধুমাত্র আমদানি রপ্তানী আর শুল্কের সীমানায় নেই। এটা বাণিজ্য যুদ্ধ ছাপিয়ে এখন রীতিমত হুমকি ধমকির পর্যায়ে চলছে।
ধারনা করা হয় পুরো পৃথিবীর জিডিপি হচ্ছে ১১৩-১১৪ ট্রিয়িলয়ন ডলারের। যার মধ্য প্রথম স্থানে আমেরিকা। যার আকার ৩০-৩১ ট্রিলিয়ন। আর নিকটতম বা দ্বিতীয় প্রতিদ্বন্দ্বি চীনের জিডিপি ১৯-২০ ট্রিলিয়ন। এরপর চার ট্রিলিয়ন ডলারের একটু বেশী জিডিপি নিয়ে চতুর্থ জার্মানী । আর তিন ট্রিলিয়ন ডলারের এর একটু বেশি জিডিপি নিয়ে জাপান আর ভারত একই অর্থনৈতিক শক্তির দেশ।
তবে এটা সত্য যে বিশ্ব অর্থনীতি একটি জটিল এবং গতিশীল ব্যবস্থা। যার "বাস্তব" আকার প্রচলিত মেট্রিক্সের চেয়ে অনেক বেশি। যদিও বিশ্বের নামমাত্র মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২০২৫ সালে ১১৩.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) এর উপর ভিত্তি করে আনুমানিক ২০৬ দশমিক ৮৮ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি সুষম অর্থনৈতিক বাস্তবতার কথা চিন্তা করছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও গবেষকরা। এটি ২০২৫ এবং তার পরেও এই বৈষম্য এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক ভূদৃশ্য গঠনের অন্তর্নিহিত শক্তিগুলির একটি বিশদ বিশ্লেষণ প্রদান করে।
বিশ্লেষণটি বর্তমান অর্থনৈতিক পরিবেশের বেশ কয়েকটি সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধি, যদিও ২০২৫ সালের জন্য গড়ে ২ দশমিক ৮ শতাংশে সামান্য হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত ভিন্ন। উচ্চ-প্রবৃদ্ধির উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতি (EMDE) তাদের উন্নত প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটছে। যা সম্প্রসারিত ব্রিকস ব্লক দ্বারা প্রমাণিত। যা এখন বিশ্বব্যাপী পিপিপি জিডিপির প্রায় ৪১ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে। গড়ে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধিও পাচ্ছে। যা জি৭-এর ১ দশমিক ২ শতাংশের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে দ্রুত ক্রমবর্ধমান।
প্রযুক্তির একটি নতুন যুগ, বিশেষ করে জেনারেটিভ এআই। প্রবৃদ্ধির একটি শক্তিশালী, যদিও ঘনীভূত চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এই খাতে বিনিয়োগ মার্কিন অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের একটি প্রাথমিক দিক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তবে এটি নতুন বাজার ঝুঁকি এবং সম্পদের চাহিদাও সৃষ্টি করছে। এই ঘনীভূত শক্তিগুলি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতিগত প্রতিকূলতার পটভূমিতে কাজ করছে। বাণিজ্য বাধার তীব্র বৃদ্ধি এবং বর্ধিত নীতিগত অনিশ্চয়তা ব্যবসায়িক মনোভাবকে দুর্বল করে দিচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্যকে করে দিচ্ছে ধীর। স্থায়ী মুদ্রাস্ফীতির চাপ, বিশেষ করে পরিষেবা খাতে, মুদ্রানীতির সিদ্ধান্তগুলিকে জটিল করে তুলছে। অন্যদিকে উচ্চতর সরকারি ঋণের স্তর দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক চ্যালেঞ্জ তৈরি অব্যাহত রেখেছে। এই কারণগুলির সংমিশ্রণ অবিরাম অনিশ্চয়তার মধ্যে ক্ষীণ স্থিতিস্থাপকতার একটি সময়কাল নির্ধারণ করে।
পিপিপি থাকা সত্ত্বেও, আধুনিক অর্থনীতির মূল্য সঠিকভাবে ধরার ক্ষেত্রে প্রচলিত জিডিপি মেট্রিক্স একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। এই পদ্ধতিটি মূলত ভৌত পণ্য উৎপাদনের আধিপত্যের যুগের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু আজকের বিশ্ব অর্থনীতি পরিষেবা এবং ডিজিটাল উদ্ভাবন দ্বারা পরিচালিত হয়।
পরিষেবা খাত বিশ্বব্যাপী নমিনাল(Nominal) জিডিপির আনুমানিক ৬৩.৬ শতাংশ এবং মার্কিন জিডিপির প্রায় ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী। একটি বাস্তব পণ্যের তুলনায় একটি পরিষেবার মূল্য সহজাতভাবে পরিমাপ করা আরও কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যসেবা পরিদর্শন বা আইনি পরামর্শের মান আউটপুটের একটি সাধারণ একক দিয়ে সহজেই পরিমাপ করা যায় না। এর ফলে অর্থনৈতিক উৎপাদনের একটি পদ্ধতিগত অবমূল্যায়ন হতে পারে। বিশেষ করে উন্নত অর্থনীতিতে। ভারতের সরকারী জিডিপি পরিসংখ্যানে পরিষেবার অংশে তা অবিশ্বাস্যভাবে কম। যা ডিজিটাল পরিষেবায় ভারত নেতৃত্বে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের তুলনায় কম দেখানো হয়েছে। পরিমাপের এই ত্রুটির জন্য একটি শক্তিশালী কেস স্টাডি প্রদান করে।
সার্চ ইঞ্জিন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওপেন-সোর্স সফটওয়্যারের মতো বিনামূল্যে বা কার্যত বিনামূল্যের ডিজিটাল পরিষেবার উত্থান একটি বিশাল "ভোক্তা উদ্বৃত্ত" তৈরি করে যা প্রচলিত জিডিপি মেট্রিক্স দ্বারা ধরা পড়ে না। এই উদ্বৃত্ত হল গ্রাহকরা কোনও পরিষেবার জন্য কী অর্থ দিতে ইচ্ছুক এবং তারা আসলে কী প্রদান করে তার মধ্যে পার্থক্য। এই পরিষেবাগুলি দ্বারা উত্পন্ন মূল্য বিশাল। কিন্তু সরকারী জিডিপি তথ্যে এটি প্রদর্শিত হয় না। যার অর্থ হল বিশ্ব অর্থনীতির প্রকৃত "প্রকৃত" আকার, বিশেষ করে এর সবচেয়ে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ক্ষেত্রগুলিতে, সরকারী সংখ্যার চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এই অগণিত মূল্যের জন্য "জিডিপি-বি" এর মতো পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বর্তমান পদ্ধতির অপর্যাপ্ততা তুলে ধরে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির ২০২৫ সালের পূর্বাভাস
• বিশ্ব জিডিপি (নমিনাল) $১১৩.৮ ট্রিলিয়ন
• বিশ্ব জিডিপি (পিপিপি) $২০৬.৮৮ ট্রিলিয়ন
• বিশ্ব জনসংখ্যা ৮.০১ বিলিয়ন
• মাথাপিছু জিডিপি, নামমাত্র $১৪,২১০
• মাথাপিছু জিডিপি, পিপিপি $২৫,৮২৮
• প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বার্ষিক % পরিবর্তন ২.৮%
• মুদ্রাস্ফীতির হার, ভোক্তা মূল্য ৪.৩%
• উন্নত অর্থনীতির জিডিপি, (নমিনাল) $৬৬.৮৭ ট্রিলিয়ন
• উদীয়মান বাজারের জিডিপি, (নমিনাল) $৪৬.৯৩ ট্রিলিয়ন
এতগুলো কথা সামনে আসে তখনই যখন মূল আলোচনা বিশ্ব অর্থনীতি আগামী দিনে কার হাতে যাবে। আমেরিকার কাছ থেকে কী বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া মুখি হবে? ইউরোপ অনেক আগেই নানান ঐতিহাসিক কারণে আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পন করে আমেরিকাকে শক্তিশালী, প্রভাবশালী আর পরাক্রমশালী করে তুলেছে। যার প্রভাব আজ ইইউ’র দেশেগুলোর পাশাপাশি বিশ্বজুড়েই পড়েছি। কথায় কথায় নিষেধাজ্ঞা আর বাণিজ্যবিরোধ। এটা না দিলে ওঠা করা হবে। ওঠা না দিলে এটা বন্ধ করে দিয়ে হবে। এমন সব হুমকি ধমকি দিয়েই যদি চলতে হবে তাহলে এত এত সংস্থা পুষে লাভ কি। বাণিজ্য ঘাটতা মেটাতে হলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থারমত প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উদ্যাগ নেয়া যেতে পারে। মার্কিন শুল্ক আগ্রাসনের মুখে একবারও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কোন গঠণমূরক দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়লো না। ফলে ব্রিকস এখন একমাত্র বিকল্প রাস্তা হতে চলেছে। আলোচিত ব্রিকস মূদ্রা আর সামরিক জোটের………।
লেখক: মো: আবু সাঈদ; ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। [[email protected]]
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
