* ১০ থেকে ১৫ বছরের পুরোনো ওসব কনটেইনার নষ্ট হয়ে রাসায়নিক বাইরে গড়িয়ে পড়ছে। যে কোনো সময় ওসব কনটেইনারে বিস্ফোরণের আশঙ্কা রয়েছে
* কনটেইনার অপসারণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে চিঠি চালাচালি চললেও অপসারণ না হওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে
শত শত বিপজ্জনক কনটেইনারে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। ১০ থেকে ১৫ বছরের পুরোনো ওসব কনটেইনার নষ্ট হয়ে রাসায়নিক বাইরে গড়িয়ে পড়ছে। যে কোনো সময় ওসব কনটেইনারে বিস্ফোরণের আশঙ্কা রয়েছে। বিপজ্জনক ওই কনটেইনার সরাতে চট্টগ্রাম কাস্টমসকে এক ডজনের বেশি চিঠি দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আবার কাস্টমস পরমাণু শক্তি কমিশনকে চিঠি দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চিঠি চালাচালি চললেও কনটেইনার অপসারণ না হওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে থাকা ৩৫৭ কনটেইনারে সালফিউরিক এসিড, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইডের মতো বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থও রয়েছে। আর তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকার ঝুঁকিতে একটি কনটেইনার শনাক্ত হলেও বন্দরের অভ্যন্তরে তেমন আরো ১২টি কনটেইনার এখনো রয়ে গেছে। তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকা ওই কনটেইনারগুলো ইয়ার্ড থেকে সরানো হয়নি। তবে ২০২৪ সালে ১৪ বছরের পুরোনো চারটি কনটেইনারে থাকা তরল রাসায়নিক ইয়ার্ড থেকে খালাস করা হয়। তবে এখনো চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এবং ওভারফ্লো ইয়াডের বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ ওসব কনটেইনার রয়ে গেছে। ওসব কনটেইনারের অনেকগুলো ভাঙা, কোনোটিতে পাউডার জাতীয় রাসায়নিক, আবার কোনোটিতে তরল রাসায়নিক রয়েছে। ওসব কনটেইনারের মধ্যে পাতলা ক্যালসিয়াম কার্বনেট, সালফেট, সোডিয়াম সালফেট বোঝাই ৯টি কনটেইনার রয়েছে। তাছাড়া ১০ থেকে ২০ বছর ধরে ওভারফ্লো ইয়ার্ডে অতি বিপজ্জনক হিসেবে পরিচিত সালফিউরিক এসিড, জিংক অক্সাইড, পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড, মিথানল, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড, ফসফরিক এসিড, ইথাইল অ্যাসিটেট ও কস্টিক সোডা বোঝাই আরো ১৩৪টি কনটেইনার পড়ে রয়েছে।
সূত্র জানায়, তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকা সন্দেহে গত ৬ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে একটি কনটেইনার শনাক্ত হয়। এর বাইরে এমন আরো ১২টি কনটেইনার রয়েছে। তার মধ্যে দুটি থেকে পরমাণু শক্তি কমিশন এখনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ আলাদা করতে পারেনি। নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষা করতে তাদের একাধিক চিঠি দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। সেগুলোর মধ্যে আছে আবুল খায়ের গ্রুপের চারটি, কেএসআরএমের দুটি, সিটাডেল গ্লোবাল করপোরেশনের দুটি, মেসার্স সাজ্জাদ হোসেনের একটি, আনোয়ার ইস্পাত লিমিটেডের একটি এবং এসএস স্টিল লিমিটেডের দুটি। তার মধ্যে ২০১৭ সালে শনাক্ত হওয়া কনটেইনারও রয়েছে। ওসব কনটেইনারের বেশির ভাগেই রয়েছে জিংক অক্সাইড মিশ্রিত পদার্থ ও স্টিলের স্ক্র্যাপ। সর্বশেষ শনাক্ত হওয়া কনটেইনারের মতো ওই ১২টি কনটেইনারও বিশেষ স্থানে আলাদা করে রাখা হয়েছে। কিন্তু কনটেইনার কিংবা সন্দেহভাজন পদার্থ পুরোপুরি অপসারণ না হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে ব্রাজিল থেকে আসা একটি কনটেইনারে পাওয়া গেছে তেজস্ক্রিয়তা। ওই কনটেইনারটিতে রয়েছে স্ক্র্যাপ বা পুরোনো লোহার টুকরো। তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্রে প্রাথমিক ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় কনটেইনারের ভেতরে তিনটি রেডিওনিউক্লাইড আইসোটোপের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ওই তিনটি হলো- থোরিয়াম ২৩২, রেডিয়াম ২২৬ ও ইরিডিয়াম ১৯২। প্রাথমিক পরীক্ষায় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা পাওয়া গেছে এক মাইক্রোসিয়েভার্টস (তেজস্ক্রিয়তা থেকে যে বিকিরণ হয় তার একক)। এটি কতটা বিপজ্জনক, তা জানতে পরমাণু শক্তি কমিশনকে চিঠি দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তার প্রকৃত মাত্রা কতটুকু তা পরীক্ষা করে তারা নিশ্চিত হবেন। এখন কনটেইনারটি আলাদা করে রাখা হয়েছে। সর্বশেষ তেজস্ক্রিয় শনাক্ত হওয়া কনটেইনারের নমুনা পরীক্ষার জন্যও চিঠি পাঠিয়েছে কাস্টমস। কিন্তু এখনো কেউ নমুনা সংগ্রহ করতে বন্দরে আসেননি।
এদিকে এ বিষয়ে কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মারুফুর রহমান জানান, বন্দরে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণের ব্যবস্থা ‘মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ রেডিয়েশন ডিটেকটিভ সিস্টেম’ এই কনটেইনারগুলো সন্দেহভাজন হিসেবে শনাক্ত করে। তার মধ্যে তিন বছরের পুরোনো কনটেইনারও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে ২০১১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে স্থাপিত হয় তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ এই যন্ত্র। এখানে সতর্ক সংকেত বেজে উঠলে কনটেইনারগুলোর খালাস স্থগিত করে তা বিশেষায়িত এলাকায় নিয়ে যায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। তবে কয়েকটি কনটেইনার থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থটি সরিয়ে নিয়েছে পরমাণু শক্তি কমিশন। কিন্তু তারা কনটেইনারটি আর ধ্বংস করেনি। অথচ তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকা কনটেইনারের পুরোটাই চরম বিপজ্জনক বলে মনে করে মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ রেডিয়েশন ডিটেকটিভ সিস্টেম। বন্দর কর্তৃপক্ষ বিপজ্জনক কনটেইনারগুলো অপসারণ করতে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে কাস্টমসকে। কাস্টম চিঠি দিচ্ছে পরমাণু শক্তি কমিশনকে। এভাবে চিঠি চালাচালির মধ্যেই ঝুঁকির মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের। এর আগেও বন্দরে একাধিকবার তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকা কনটেইনার এসেছে। সেগুলোর কোনোটি থেকে সন্দেহজনক পদার্থটি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু কনটেইনার এখনো রয়ে গেছে। পরমাণু শক্তি কমিশনের গাইডলাইন মেনে এগুলো সরানো হবে। তাদের ছাড়পত্র না পেলে কনটেইনার নিলামেও তোলা যাচ্ছে না। তবে যেসব কনটেইনারে বিপজ্জনক রাসায়নিক রয়েছে, সেগুলো ধীরে ধীরে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। তবে পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকায় বন্দর থেকে বিপজ্জনক অনেক কনটেইনার সময়মতো সরানো সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান পদার্থ বিজ্ঞানী মাসুদ কামাল জানান, গবেষণা, চিকিৎসা, শিল্পকারখানা, ল্যাব টেস্টসহ নানা কাজে তেজস্ক্রিয় উৎস ব্যবহার হয়। তেজস্ক্রিয় উৎস ব্যবহারের সময় খুব সতর্ক থাকতে হয়। বায়ুরোধী বিশেষ পাত্রে এটি এমনভাবে আবদ্ধ রাখতে হয়, যাতে তেজস্ক্রিয় উৎস বাইরে আসতে না পারে। রাসায়নিক পদার্থও দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে দাহ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়। কোনো কারণে তেজস্ক্রিয় উৎস বাইরে গেলে কিংবা রাসায়নিক বিকিরণ ঘটলে মানব শরীর ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের মুখপাত্র ও সচিব ওমর ফারুক জানান, তেজস্ক্রিয় ও রাসায়নিক থাকা কনটেইনারগুলো চরম ঝুঁকিপূর্ণ। তার মধ্যে ১০ থেকে ২০ বছরের পুরোনো কিছু কনটেইনার রয়েছে। সেগুলো অপসারণ করতে বন্দর কর্তৃপক্ষ কাস্টমসকে এক ডজনের বেশি চিঠি দিয়েছে। কিছু কনটেইনার সরালেও এখনো সাড়ে ৩শ’র বেশি বিপজ্জনক কনটেইনার বন্দরে রয়েছে। তার মধ্যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকার সন্দেহভাজন ১২টি পুরোনো কনটেইনার রয়েছে। শনাক্তসহ সেগুলো বিশেষায়িত জায়গায় আলাদা করে রাখা হয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে ওসব কনটেইনার দ্রুত অপসারণ করা জরুরি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

মেয়াদোত্তীর্ণ কনটেইনারে ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম বন্দর
- আপলোড সময় : ১২-০৯-২০২৫ ০১:১৫:৫০ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১২-০৯-২০২৫ ০১:১৫:৫০ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ