* সাভার-আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে এক বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ২১৪টি কারখানা। তার মধ্যে স্থায়ীভাবে ১২২টি ও অস্থায়ীভাবে ৯২টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে।
* বন্ধ হওয়ায় ওসব কারখানার প্রায় ৩১ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।
* প্রশাসনিক, রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ে কড়াকড়ি এবং বিভিন্ন কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় কর্তৃপক্ষ কারখানাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে
এক বছরে বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন খাতের শত শত কারখানা। ফলে হু হু করে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। ইতিমধ্যে বেকার হয়ে পড়েছে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে গত এক বছরে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে বেকার হয়েছেন এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ শ্রমিক। কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার ছাড়াও কাঁচামাল আমদানিতে এলসি সমস্যা, শিল্পে অব্যাহত গ্যাসসংকট, দফায় দফায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়া, অব্যাহতভাবে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচে অনেকে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে শিল্প মালিকরা চরম সংকটের কারণেই বাধ্য হচ্ছেন কারখানা বন্ধ করতে। কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, শিল্প পুলিশ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সাভার-আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে এক বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ২১৪টি কারখানা। তার মধ্যে স্থায়ীভাবে ১২২টি ও অস্থায়ীভাবে ৯২টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। বন্ধ হওয়ায় ওসব কারখানার প্রায় ৩১ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ে কড়াকড়ি এবং বিভিন্ন কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় কর্তৃপক্ষ কারখানাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। আর গাজীপুর জেলায় একে একে শিল্প-কারখানা বন্ধ হচ্ছে। তাতে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। কাজ না পেয়ে তাঁরা যুক্ত হচ্ছেন নানা অপরাধে। এক বছরে গাজীপুরে ৭২টি কলকারখানা বন্ধ করা হয়েছে। কারখানা বন্ধ হওয়ায় জেলায় বেকার হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। গত ফেব্রুয়ারিতে অর্থাভাবে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয় রপ্তানিমুখী বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩ পোশাক কারখানা। আর চাকরি হারানো শ্রমিকদের খুব কমই অন্য কারখানায় চাকরি পেয়েছেন।
সূত্র জানায়, গাজীপুরে গত জানুয়ারিতে ৪৩টি কারখানা বন্ধ হয়। বেক্সিমকোর ১৩টিসহ বাকি কারখানাগুলো গত ছয় মাসে বন্ধ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বেকার হয়েছেন ৭৩ হাজার ১০৩ জন শ্রমিক। কারখানাগুলোর বেশির ভাগই কাজ না থাকা, কার্যাদেশ বাতিল এবং আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়েছে। তাছাড়া কারখানার মালিকানা পরিবর্তন, ব্যাংকঋণ রিশিডিউল না করা, কাজ না থাকা ইত্যাদি কারণে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। মূলত বেশির ভাগ কারখানা আর্থিক সংকটের কারণেই বন্ধ হচ্ছে। তাছাড়া দেশের বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামে গত এক বছরে ২১টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। তাতে জাহাজ ভাঙাসহ বিভিন্ন কারখানার কমপক্ষে ১০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছে। ২১ কারখানাসহ ২০০৫ সাল থেকে তৈরি পোশাক ও শিপ ব্রেকিং (জাহাজ ভাঙা শিল্প) ওই দুটি প্রধান শিল্প খাতে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে ৪১৬ কারখানা। বিজিএমইএর তথ্যানুসারে, ২০০৫ সালে চট্টগ্রামে ৬৯৯টি নিবন্ধিত কারখানার মধ্যে ৬১০টি সচল ছিল, সেখানে এখন ৩৫০টি কারখানা চালু রয়েছে। বাকি ২৬০টি কারখানায় তালা ঝুলছে। তার মধ্যে গত বছর ১৪টি ও চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে ৭টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। তার বাইরে এক বছরে একাধিক জাহাজ ভাঙা কারখানা বন্ধ এবং কয়েকটি কারখানায় বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কমানো হয়েছে। ক্রয়াদেশ কমার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও ব্যাংকিং সংকটও ওসব কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণ।
সূত্র আরো জানায়, চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শিল্পে তৈরি পোশাক খাতের চেয়ে বেশি সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিবছর সীতাকুণ্ডে ২০০ থেকে ২৫০টি জাহাজ ভাঙা হয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলে ২০ কিলোমিটারজুড়ে গড়ে উঠেছিল ১৮০টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। বর্তমানে সেগুলোর বেশির ভাগই বন্ধ। বর্তমানে ২৪টি চালু আছে। ১৫৬টি ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত দুই লাখ শ্রমিক-কর্মচারী আগেই বেকার হয়ে পড়েছেন।বেশির ভাগ ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার বাড়ছে। কখনো অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপ, কখনো আন্তর্জাতিক বাজারে লোহার মূল্যবৃদ্ধি- এসব কারণে মালিকরা বিপুল লোকসানের শিকার হয়েছে। তাছাড়া ব্যবসা বন্ধ থাকলেও এলসির বিপরীতে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ বন্ধ ছিল না, ফলে মালিকরা কঠিন সংকটে পড়ে। ডলার সংকট, এলসি খুলতে ব্যাংকের কঠোর শর্ত এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণেও এই শিল্পে চরম দুরবস্থা দেখা দিয়েছে। আর নতুনভাবে কারখানা স্থাপনে আগ্রহীরা গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগও পাচ্ছেন না। আর নারায়ণগঞ্জে ছোট-বড় এক হাজার ৮৩৪টি পোশাক কারখানা রয়েছে। এক বছরে বিভিন্ন কারণে ২৬টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়ে গেছে। তাতে পাঁচ হাজার ৩৪২ জন চাকরি হারিয়েছেন। পোশাক কারখানার মধ্যে বেশির ভাগই বন্ধ হয়েছে আর্থিক সংকট এবং পর্যাপ্ত কাজের অভাবে। স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়াও গত এক বছরে নারায়ণগঞ্জের ১৯টি কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি কারখানা লে-অফ করা হয়েছে। তবে নারায়ণগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর দিচ্ছে ভিন্ন হিসাব। তাদের হিসাবে, নারায়ণগঞ্জে নিবন্ধনকৃত পোশাক কারখানা এক হাজার ১০টি। এর মধ্যে গত এক বছরে ৯টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া নরসিংদীতে বিভিন্ন শ্রেণির কারখানা রয়েছে দুই হাজার ২৫১টি। এর মধ্যে বড় ৪০টি, মাঝারি ৭১টি ও ছোট দুই হাজার ১৪০টি। এর মধ্যে ছোট কারখানা বন্ধ হয়েছে ২০টি। এতে কর্মহীন হয়েছেন প্রায় ৫০০ শ্রমিক-কর্মচারী।
দেশে কারখানা বন্ধ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোরশেদ সারোয়ার সোহেল জানান, বিগত সরকারের আমল থেকেই ফ্যাক্টরিগুলো দুর্বল অবস্থায় ছিল। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব থেকেই বন্ধ শুরু হয়। ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যাওয়া, কার্যাদেশ কমতে থাকা, শ্রমিক অসন্তোষ- এসব কারণে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ না এলে আগামী দিনে আরো কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

অর্থনীতিতে অশনি সংকেত শত শত কারখানা বন্ধ
- আপলোড সময় : ১৩-০৯-২০২৫ ০১:১৫:৩৮ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৩-০৯-২০২৫ ০১:১৫:৩৮ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ