বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ খতিয়ে দেখতে একটি জরিপে চালিয়েছে বেসরকারি সংস্থা আচঁল ফাউন্ডেশন। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ মে পর্যন্ত এ জরিপে সারা দেশের ৮৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫৬ জন পুরুষ ও ৮১৩ জন নারীসহ ১ হাজার ৫৭০ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। এতে উঠে এসেছে, ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী হতাশায়, ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। এ ছাড়া ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যা চিন্তায় এসেছে। গতকাল শুক্রবার ‘বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ’ শীর্ষক সমীক্ষা নিয়ে ভার্চ্যুয়ালি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ। তিনি জানান, জরিপে উঠে এসেছে, ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে হতাশার বিভিন্ন উপসর্গ, যেমন: ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া, কোনো কিছু উপভোগ না করা, ঘুমের ধরনের পরিবর্তন, আত্মহত্যার চিন্তা, কাজে মনোযোগ দিতে না পারা ইত্যাদি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। মাত্র ২০ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন যে তাদের এই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। হতাশার উপসর্গ পূর্বের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে জানা যায়, ৬৬ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থীদের আগের তুলনায় বেশি সময় হতাশার উপসর্গ নিজের মাঝে অনুভব করেছেন। এর মধ্যে হতাশার উপসর্গে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে। জরিপে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের হতাশার বিভিন্ন কারণ উঠে এসেছে। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। বিভিন্ন কারণে নিজেকে অন্যান্যের সঙ্গে তুলনা করার কারণে হতাশায় ভুগছেন ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা নিয়ে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, হল বা আবাসিক পরিবেশ নিয়ে ৯ শতাংশ, সহপাঠী বা শিক্ষক কর্তৃক বুলিংয়ের কারণে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ওপরের সব কটির জন্য ১ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী হতাশাগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া আরও ৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্যান্য কারণে হতাশায় ভুগছেন। তিনি বলেন, আমাদের জরিপে দেখা গিয়েছে, অংশগ্রহণকারী মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন ৩১ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী। যার মাঝে বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ, র?্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হননি ৬৮ দশমিক ৯ শতাংশ। জরিপে আরও উঠে এসেছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহপাঠী বা সিনিয়র দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ, শিক্ষক কর্তৃক ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, স্টাফ কর্তৃক ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং অন্যান্যের দ্বারা ৫ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী হয়রানির শিকার হয়েছেন। হয়রানির ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর, মোটামুটি প্রভাব পড়েছে ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর এবং কোনোরূপ প্রভাব পড়েনি ৮ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর। জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে পুরোপুরি অসন্তুষ্ট ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, মোটামুটি সন্তুষ্ট ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ এবং পুরোপুরি সন্তুষ্ট মাত্র ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। পড়াশোনার পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্টি হওয়া পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। আঁচল ফাউন্ডেশনের জানিয়েছে, ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী তারা মন খুলে কথা বলার মতো কোনো শিক্ষক পান না। এর মাঝে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজ শিক্ষকদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না এবং ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তারা খুব সহজে নিজ বিভাগের শিক্ষকদের সামনে নিজেকে মেলে ধরতে পারেন। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৮ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং ৪১ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী ফ্যাকাল্টির অন্য সদস্যদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। এ জরিপে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের পরিবেশ নিয়ে ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা পুরোপুরি অসন্তুষ্ট। সন্তুষ্টির কথা বলেছেন মাত্র ১০ দশমিক ০০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকিরা জানিয়েছেন, তারা মোটামুটি সন্তুষ্ট। অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে দেখা যায়, ৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী থাকার পরিবেশকে দায়ী করেছেন। অনুন্নত খাবারকে দায়ী করেছেন ৭ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। রিডিং রুম বা গ্রন্থাগারের সংকট মনে করছেন ৩ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং সব কারণকেই দায়ী করছেন ৬৮ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ১০ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা অন্যান্য কারণকে অসন্তুষ্টির জন্য দায়ী করছেন। ৭০ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন হলের পরিবেশ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জরিপে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যারিয়ার হিসেবে সরকারি চাকরি করতে চান, ৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যবসা বা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, মাত্র ৭ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি চাকরি করতে চান। এ ছাড়া বাকি শিক্ষার্থীরা এখনও কোনোরূপ ক্যারিয়ার ভাবনা ঠিক করেননি, যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২২ শতাংশ। জরিপে অংশগ্রহণকারী মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, আত্মহত্যা চিন্তায় এসেছে কিন্তু করেননি ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ, আত্মহত্যা চিন্তা এসেছে এবং উপকরণও জোগাড় করেছেন ৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং কখনও মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা আসেনি ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর। ক্যারিয়ার ভাবনা থেকে আত্মহত্যার চিন্তা ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর জানিয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০ শতাংশ ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশায়, ১৬ দশমিক ২ শতাংশ মা-বাবার সঙ্গে অভিমানের ফলে, ৯ দশমিক ৭ শতাংশ প্রেমঘটিত বিষয়ে, ৯ শতাংশ অর্থনৈতিক সমস্যাগ্রস্ত হয়ে, অন্যরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় ৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করার চিন্তা এসেছে বলে জানিয়েছেন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুল নিয়ে ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘হ্যাঁ’সূচক এবং ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘না’সূচক উত্তর দিয়েছেন। এ ছাড়া ২৬ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা এই সম্পর্কে কোনো কিছু জানেন না।
আঁচল ফাউন্ডেশনের কিছু প্রস্তাব: ক্যাম্পাসে কাউন্সেলিং ইউনিটের ব্যবস্থা করা, ক্যাম্পাসে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা, ক্যাম্পাসে কেউ যেন বুলিংয়ের শিকার না হয়, তা মনিটরিং করা, নিরাপদ বাসস্থান ও উন্নত মানের খাদ্যব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, প্রয়োজনে বৃত্তি ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সম্মান ও আস্থার সম্পর্ক উন্নয়ন, প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করানো, মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা, সেমিনার ও মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা, বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী বা বিশেষজ্ঞদের এসব সেশনে বিভিন্ন সমস্যা ও এগুলোর সমাধান নিয়ে লেকচার দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে এবং দেশের সব স্কুল, কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট (মনোবিদ) এডুকেশনাল কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক কামাল উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক ওবায়দুল্লাহ আল মারজুক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশর সিনিয়র লেকচারার আবদুল্লাহ আল হারুন প্রমুখ।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ৭৯.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী হতাশায় ভুগছেন : আঁচল ফাউন্ডেশন
- আপলোড সময় : ০৮-০৬-২০২৪ ১২:২৬:৩৬ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৮-০৬-২০২৪ ১২:২৬:৩৬ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ