ঢাকা , বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫ , ১৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
সবাই মিলে রাষ্ট্র বিনির্মাণের সুযোগ হয়েছে-আলী রীয়াজ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বদলিতে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য ১৭ অভিনয়শিল্পীর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলার আবেদন রাস্তায় অভিনেতাকে সিদ্দিককে গণপিটুনি কারিগরি শিক্ষার্থীরা যা শিখছেন, চাকরির বাজারে তার চাহিদা নেই -সিপিডি আগামী নির্বাচনে সীমিত পরিসরে হলেও প্রবাসীদের ভোটের প্রস্তুতি চলছে : সিইসি জনবান্ধব পুলিশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে-স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুলিশকে উজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব জমা দিতে গড়িমসি অপকর্ম বন্ধ করুন, নইলে বিএনপিকেও জনগণ ছুড়ে মারবে -নেতাকর্মীদের ফখরুল সভ্য হতে হলে প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে হবে : এনবিআর চেয়ারম্যান বইপ্রেমী এক ডিসির গল্প গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে চিকিৎসাধীন অন্তঃসত্ত্বার মৃত্যু গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ দুই বোন ই-৮ ভিসায় দক্ষিণ কোরিয়ায় গেলেন ২৫ কর্মী পুলিশের জন্য ১৭২ কোটি টাকায় কেনা হবে ২০০ জিপ সামাজিক সুরক্ষায় যুক্ত হচ্ছে আরও ৬ লাখ ২৪ হাজার উপকারভোগী ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনে লিপ্ত থাকার অভিযোগ গ্যাস খাতে বছরে আর্থিক ক্ষতি বিলিয়ন ডলার নতুন লুকে নজর কাড়লেন ব্লেক লাইভলি
গোমতীর বাঁধ ভেঙে তলিয়েছে বুড়িচং * এখনো ডুবে আছে খাগড়াছড়ির মেরুং

উন্নতি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি

  • আপলোড সময় : ২৩-০৮-২০২৪ ১০:৩০:১৮ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৪-০৮-২০২৪ ১২:১০:৫৭ পূর্বাহ্ন
উন্নতি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কুমিল্লার গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। ছবিটি গতকাল শুক্রবার বুড়িচং উপজেলার ইছাপুর গ্রাম থেকে তোলা
জনতা ডেস্ক
দেশের সাত নদীর ১৪ স্টেশনের পানি এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। তবে বেশিরভাগ অঞ্চলের নদীর পানি স্থিতিশীল আছে। কিছু এলাকার নদীতে পানি ধীরগতিতে কমছে। এছাড়াও গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভারী বৃষ্টিপাত হয়নি, যার ফলে ফেনী, কুমিল্লাসহ পাঁচ জেলায় ধীরগতিতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার তথ্য দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করেছে দেশের ১৩ জেলায়। পানিবন্দি ও ক্ষতির মুখে পড়েছে ৩৬ লাখের মতো মানুষ। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়িয়েছে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায়। ফেনী পৌর শহরও পানিতে তলিয়ে গেছে। ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির কারণে কুমিল্লা জেলার গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে গোটা বুড়িচং উপজেলাটি তলিয়ে গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় একটি সেতুর অংশ ধসে পড়ার কারণে কসবা উপজেলার সঙ্গে আখাউড়ার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এই সড়কের আরেকটি সেতু মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলার নিচু এলাকা হওয়ার কারণে দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রাম এখনো পানিবন্দি।
এদিকে পানিবন্দিদের উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আটকেপড়া বন্যা দুর্গতদের হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারি বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যায় দুই নারীসহ ১৩ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গত মঙ্গলবার থেকে গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সাত জেলায় এসব মৃত্যু ঘটে। এরমধ্যে কুমিল্লায় ৪ জন, ফেনীতে ১ জন, চট্টগ্রামে ২ জন, নোয়াখালীতে ১ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, লক্ষ্মীপুরে ১ জন ও কক্সবাজারে ৩ জন রয়েছেন।
ফেনীর ৬ উপজেলার লাখো মানুষ এখনো পানিবন্দি: ফেনী জেলার ছয় উপজেলা এখনো প্লাবিত। পানি সরে যায়নি। পানিবন্দি হয়ে লাখ লাখ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। সুপেয় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সেখানে আটকেপড়া বন্যা দুর্গতদের হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক ইমরান হোসেন এতথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ফেনীতে আটকেপড়া বন্যা দুর্গতদের হেলিকপ্টারে উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ করছে র‌্যাব। ছাগলনাইয়া উপজেলার ১০ নম্বর ঘোপাল ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিজকুঞ্জরা গ্রামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বন্যার পানিতে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী একটি বাস আটকা পড়েছে। বাসটিতে ৫০ জনের মতো যাত্রী আছেন। গত বুধবার বাসটি চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে এসেছিল। উজানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢল ও গত কয়েক দিনের প্রবল বৃষ্টিতে ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরামÑএ তিন উপজেলা পুরোটাই বন্যাকবলিত। জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার ৮০ শতাংশ এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সোনাগাজী উপজেলার সব ইউনিয়নে বন্যার পানি ঢুকেছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ দুর্ভোগে আছেন। এছাড়া বিভিন্ন গ্রামে প্রায় এক লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। বন্যাকবলিত প্রায় সব এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। বেশিরভাগ মোবাইল টাওয়ার অকেজো হয়ে পড়ায় যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার সকাল ৯ টা থেকে ফেনী সদরের তিনটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, অথই পানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, চাষের জমি; বিস্তীর্ণ প্রান্তর। অনেক গ্রামে বাড়ির পর বাড়ি খালি পড়ে আছে। আবার কিছু এলাকায় আটকে আছেন বাসিন্দারা। এই এলাকায় সকাল ১০টা থেকে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস। সংস্থার চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, দুটি টিম ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। ফেনীতে অন্তত এক লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি। সকাল আটটায় চট্টগ্রাম নগরের এ কে খান ও অলংকার থেকে ঢাকা, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করা দূরপাল্লার বাস চলাচল করতে দেখা যায়নি। মহাসড়কে ট্রাক, কনটেইনারবাহী ট্রেইলর, ব্যক্তিগত কার, মিনি ট্রাক দেখা গেছে। তবে চট্টগ্রাম নগর থেকে মিরসরাই উপজেলার বারইয়ারহাট পর্যন্ত ছোট আকারের কিছু বাস যাচ্ছে। এই প্রতিবেদক সকাল ৭টায় ফেনীর উদ্দেশে রওনা দেন। কিছু দূর হেঁটে, কিছুদূর সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও কিছুদূর বাসে করে ফেনীতে পৌঁছান। সকালে এ কে খান এলাকায় কথা হয় মো. আলমগীর নামের এক চাকরিজীবীর সঙ্গে। তার বাড়ি কুমিল্লা। বন্যার পানিতে বসতবাড়ি ডুবে গেছে। পরিবারের সদস্যদের চট্টগ্রামে নিয়ে আসার জন্য কুমিল্লা যেতে চান। তবে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পরও কোনো বাস পাননি। বাধ্য হয়ে বারইয়ারহাটের একটি বাসে উঠেছেন। মো. আলমগীর বলেন, ভেঙে ভেঙে যেতে হবে তাঁকে। বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ায় বিপদে পড়েছেন।
ট্রাক চালকদের সঙ্গে কথা বলে ও ফেনী সদরে ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশ, কুমিল্লা অংশে মহাসড়কের ওপর বন্যা পানি জমে আছে। কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও বুক সমান পানি হয়েছে। এ কারণে বাস চলাচল করতে পারছে না। মোহাম্মদ সাইফুল নামের এক ট্রাক চালক যাবেন ঢাকায়। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মিরসরাই এসে আটকে আছেন। কোনো নড়চড় নেই।
সরেজমিন দেখা যায়, মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট থেকে ঢাকাগামী অন্তত ৩০ কিলোমিটার সড়কে হাজার হাজার যানবাহন আটকে আছে। কেউ ১০ ঘণ্টা, কেউ ২৪ ঘণ্টা ধরে আটকে আছেন। নারী  শিশুরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। অনেকে শিশুদের নিয়ে হেঁটেই গন্তব্যে যাচ্ছেন। ইয়াসমিন আক্তার ও জয়নাল মিয়া দম্পতি তাদের মেয়েকে নিয়ে ঢাকা যাবেন। গতকাল বিকেলে বাসে উঠেছিলেন। পরে ফেনী সদরে ঢোকার মুখে আটকে গেছেন। গত রাতে অপেক্ষার পর আজ সকাল ১০ টায় হাঁটা শুরু করেন। পরে কয়েকজন মিলে মিনি ট্রাক ভাড়া করেছেন। জয়নাল বলেন, উল্টো পথে যতটুকু যেতে পারেন যাবেন।
গোমতীর বাঁধ ভেঙে তলিয়েছে বুড়িচং: ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কুমিল্লা গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে গোটা বুড়িচং উপজেলাই তলিয়ে গেছে। উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের পানিবন্দি মানুষ বিশুদ্ধ পানি আর খাবার সংকটের কারণে দিশেহারা অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। যেভাবে তীব্র বেগে পানি ঢুকছে এতে দ্রুতই পাশের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবাও প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এই অবস্থায় পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পাশাপাশি কাজ শুরু করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান বলেন, গত  বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে বুড়বুড়িয়া এলাকায় প্রতিরক্ষা বাঁধের নিচ দিয়ে পানি বের হচ্ছিল। স্থানীয় লোকজন বালুর বস্তা ফেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। রাত পৌনে ১২টার দিকে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। বাঁধের অন্তত ৩০ ফুট ভেঙে গেছে। নদীর পানি না কমলে এই বাঁধ মেরামত করা সম্ভব না। নদীর পানি যতদিন না কমবে ততদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে থাকবে।
প্রকৌশলী বলেন, গতকাল শুক্রবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত গোমতীর পানি বিপৎসীমার ১০৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ বিপৎসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। সে হিসেবে পানি কিছুটা কমেছে। নদীর শহর রক্ষা বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, অন্য কোথাও যেন বাঁধ না ভাঙে সেদিকে লক্ষ্য রাখার। পাউবো কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯৭ সালে গোমতীর পানি বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। কিন্তু গত দুইদিনে পানি বাড়ার হিসাব অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার বলেন, এখন আর গ্রাম, ইউনিয়ন হিসাব করে লাভ নেই। পুরো বুড়িচংই পানির নিচে। প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করায় প্রতিনিয়ত পানির উচ্চতা বেড়েই চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে আশপাশের উপজেলাও প্লাবিত হতে পারে। ইউএনও বলেন, বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই স্থানীয় লোকজনকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে এলাকায় মাইকিং করা হয়। এরই মধ্যে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছেন। পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারকে কাজ চলছে।
স্থানীয় প্রশাসন, সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছেন বলে জানান সাহিদা আক্তার।
গোমতীতে এত পানি আগে দেখিনি: স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া গ্রামের কাছে গোমতী নদীর বাঁধটি ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। গতকাল শুক্রবার দুপুর ২টার মধ্যে সারা উপজেলা গোমতীর পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়। বাঁধ ভাঙার পর থেকেই বুড়িচং উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে শুরু করে। বর্তমানে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এই সময়ে মানুষকে উদ্ধার করাই বড় কাজ বলে মনে করেন কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বুড়িচংয়ের বুড়বুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামে বর্তমানে গলা সমান পানি। পুরো গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। মানুষের দুর্ভোগ বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। গোমতীতে এতো পানি আগে কখনো দেখিনি। উপজেলার শিমাইলখাড়া গ্রামের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা সৌরভ বলেন, পানি হু হু করে ঢুকছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান সোনার বাংলা কলেজে আশ্রয়কেন্দ্র আছে। মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসে নিরাপদে থাকতে বলা হচ্ছে।
উপজেলার গাজীপুর এলাকার বাসিন্দা সালমা হক বলেন, আমাদের বাসার মালামাল ছাদের উপরে রেখেছি। পানি বাড়ছে। আমার মাকে নিয়ে কুমিল্লা শহরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া সড়কে পানি ওঠায় যানচলাচল বন্ধ। বলতে গেলে চরম দুর্ভোগে পড়েছি। এলাকার সব বাড়িঘর পানির নিচে। এদিকে আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার সঙ্কটে শিশু-বৃদ্ধসহ বিপাকে পড়েছেন মানুষজন। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বুড়িচং উপজেলা প্লাবিত হতে শুরু করলে মানুষজন প্রাণ রক্ষায় ছুটতে থাকেন আশ্রয়কেন্দের দিকে। তবে সেখানে রয়েছে খাবার ও চিকিৎসা-সংকট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুড়িচং উপজেলার মহিষমারা উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রয় নেয়ার পর থেকে সেখানে কেউই খাবার ও চিকিৎসাসেবা নিয়ে যায়নি।
মহিষমারা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রশিদ আহমেদ বলেন, খাবার না থাকার বিষয়টি আমরা আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদের জানিয়েছি। কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত, তারাও বিপদে আছে। যাদের পক্ষে সম্ভব দ্রুত ত্রাণ নিয়ে মহিষমারা উচ্চবিদ্যালয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, এখানকার প্রায় ৫০০ মানুষ না খেয়ে আছে। শিশুরা কান্না করছে। বের হওয়ার কোনো অবস্থা নেই। কারণ বিদ্যালয়ের নিচতলা পানিতে ডুবে গেছে।
আতঙ্কে কুমিল্লা নগরবাসীও: এদিকে বুড়িচংয়ে গোমতীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই আতঙ্কে ঘুম নেই কুমিল্লা নগরবাসীর। কারণ গোমতী নদীর পাড়েই অবস্থান এই নগরী। গত বৃহস্পতিবার প্রায় পুরো রাতই নগরীর সিংহভাগ মানুষ জেগে ছিলেন বাঁধ ভাঙার আতঙ্কে। নগরীর বাসিন্দাদের শঙ্কা, গোমতীর বাঁধ ভাঙলেই তলিয়ে যাবে গোটা শহর। নগরীর কাপ্তান বাজার এলাকার বাসিন্দা সামছুল আলম বলেন, বুড়িচংয়ে বাঁধ ভাঙার খবর পাওয়ার পর থেকেই মানুষ আতঙ্কে আছে। কারণ, গোমতীর বাঁধ ভেঙে গেলে পানিতে তলিয়ে যাবে গোটা শহর। এমনিতে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরীর সড়কগুলো তলিয়ে যায়। যদি গোমতীর বাঁধ ভেঙে যায়, তবে পুরে শহর তলিয়ে যাবে। জেলার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ, লাকসামসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার বেশিরভাগ গ্রাম এখনো বন্যার পানিতে ডুবে আছে। তবে বৃহস্পতিবারের তুলনায় গতকাল শুক্রবার এসব উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম উপজেলার দুই কিলোমিটার এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়। গতকাল শুক্রবার এই স্থানে মহাসড়কে পানি দেখা যায়নি।
এখনো ডুবে আছে খাগড়াছড়ির মেরুং: বৃষ্টি না থাকায় খাগড়াছড়ি জেলা সদরের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। তবে নিচু এলাকা হওয়ার কারণে দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রাম এখনো পানিবন্দি। মেরুং ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ঘনশ্যাম ত্রিপুরা বলেন, বন্যায় ইউনিয়নের অন্তত ৪০ গ্রামের মানুষ এখনো পানিবন্দি। মেরুং বাজার এখনো পানিতে প্লাবিত। গতকাল শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে মেরুংয়ে একাধিক এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন গ্রামের অনেক ঘরবাড়ি এখনো পানির নীচে। মেরুং ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম ছদকা ছড়া। নৌপথে মেরুং বাজার থেকে যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। সেখানে গিয়ে দেখা যায় ছদকাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখনো অন্তত সাত ফুট পানির নীচে। ছদকাছড়া গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় কার্বারি এপেকশন চাকমা বলেন, সোমবার থেকে পানি বাড়তে শুরু করেছে। এখনো গ্রাম থেকে পানি নেমে যায়নি। আরো কয়েকদিন সময় লাগবে। বৃষ্টি না থাকলে পানি কমবে। এই নিয়ে এ বছর আমরা চার দফায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
মেরুং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সমীরন চাকমা বলেন, আমার ওয়ার্ডের সাতটি গ্রাম এখনো বন্যার পানিতে ডুবে আছে। সোমবার রাত থেকে তারা পানিবন্দি।
মেরুং ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ঘনশ্যাম ত্রিপুরা বলেন, মেরুং ইউনিয়নের প্লাবিত অনেক গ্রামে মোবাইল সংযোগ নেই। গতকাল শুক্রবার সেসব দুর্গম এলাকায় ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। সবকটি আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুনুর রশিদ বলেন, আজকে (শুক্রবার) আমরা একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণ দিয়েছি। দেড় শতাধিক পরিবারকে শুকনো খাবার, চাল, ডালসহ খাদ্য উপকরণ দেয়া হয়েছে। যে সমস্ত এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই তাদের পরিস্থিতি আমরা সরেজমিনে দেখেছি। প্রশাসনের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা মেরুং ইউনিয়নে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে। তবে সড়ক থেকে পানি না নামায় খাগড়াছড়ির সঙ্গে সাজেক ও লংগদুর সড়ক যোগাযোগ এখনো বন্ধ রয়েছে।
সাজেকে আটকেপড়া পর্যটকরা ফিরেছেন নিরাপদে: খাগড়াছড়িতে ঢলের পানিতে ডুবে যাওয়া বাঘাইহাট-সাজেক সড়কের পানি সরে যাওয়ায় সাজেক পর্যটনকেন্দ্রে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। এতে সাজেকে আটকেপড়া দুই শতাধিক পর্যটক নিরাপদে ফিরে গেছেন। গতকাল শুক্রবার দুপুরে পর্যটকদের বহনকারী গাড়িগুলো সাজেক থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে ছেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। এর আগে, বৃহস্পতিবার বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় কাচালং নদীর পাহাড়ি ঢলও কমে যায়। ফলে বাঘাইহাট-সাজেক সড়কের তলিয়ে যাওয়া তিন স্থানের পানি কমে গিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এরপর গত তিন দিনে আটকে পড়া ২৬০ জন পর্যটক খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
দুপুরে পর্যটকদের বহনকারী জিপ, মাহিন্দ্রা, মোটরসাইকেল সাজেকের রুইলুই পর্যটনকেন্দ্রের প্রবেশমুখে লাইন ধরে দাঁড়ায়। পরে দুপুরে ১৩টি জিপ ও ৬০টি মাহিন্দ্রা-মোটরসাইকেলে ওই পর্যটকরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। গত মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে বাঘাইহাট থেকে সাজেকে এসব পর্যটক বেড়াতে যান। ওই দিন দুপুর ১২টার দিকে ভারী বৃষ্টি হলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কাচালং নদী উপচে বাঘাইহাট-সাজেক সড়কের বাঘাইহাট এলাকায় দুটি স্থান এবং মাচালং বাজার এলাকা ডুবে যায়। এতে এই সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে পর্যটকরা সাজেকে আটকা পড়েন।
সাজেক পর্যটনকেন্দ্রের গাড়ির লাইন ম্যান মো. ইয়াছিন আরাফাত বলেন, আটকে পড়া পর্যটকরা আজ (শুক্রবার) দুপুরে সাজেক থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। সাজেক রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি সুপর্ণ দেব বর্মণ বলেন, আটকে পড়া পর্যটকরা গতকাল শুক্রবার) নিরাপদে ফিরে গেছেন। রিসোর্ট-কটেজে আটকে পড়া পর্যটকরা যতদিন ছিলেন, কোনো কক্ষের ভাড়া নেওয়া হয়নি। শুধু পানির বিল নেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আটকে পড়লে পর্যটকদের এ সুযোগ দেওয়া হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমেনি দুর্ভোগ: উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে লোকালয় থেকে পানি নামতে শুরু করলেও কমেনি দুর্ভোগ। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে নতুন করে আর কোনো গ্রাম প্লাবিত হয়নি। এ ছাড়া হাওড়া নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। তবে এখনও পানিবন্দি অবস্থায় আছেন পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। বর্তমানে হাওড়া নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে ২১ অগাস্ট আখাউড়া উপজেলার বঙ্গেচর, আব্দুল্লাহপুর, খলাপাড়া, বাউতলা, আড়িয়ল ও কালিকাপুরসহ প্রায় ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পরদিন পরিস্থিতির অবনতি হলে নতুন করে আরও অন্তত পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়। এ ছাড়া পানির তোড়ে উপজেলার কর্নেল বাজার ও খলাপাড়া এলাকায় হাওড়া নদীর দুটি বাঁধ ভেঙে যায়। এতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। তবে বৃহস্পতিবার রাত থেকে ঢলের পানির বেগ কমায় এবং বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে থাকে। দুর্গত এলাকা থেকে নেমে যাচ্ছে পানি। তবে পানি পুরোপুরি না সরায় দুর্ভোগ কমেনি বাসিন্দাদের।
গত বুধবার মধ্যরাতে হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে পানির তোড়ে বসতঘর ভেসে যায় উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের খলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা নারগিস আক্তারের। তিনি বলেন, কোনো জিনিসপত্রই রক্ষা করতে পারি নাই। অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। পানিতে ঘরের জায়গার মাটি সরে যাওয়ায় নতুন করে এখন ঘরও বানাতে পারব না। একই এলাকার আরেক বাসিন্দা আঙ্গুরা বেগম জানান, রাত থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। তবে রান্নাঘরে এখনও পানিতে আছে। ফলে রান্না করা যাচ্ছে না। তাই দোকান থেকে চিড়া-মুড়ি কিনে খাচ্ছেন তারা। ষাটোর্ধ্ব আবুল কাশেম জানান, ঘর থেকে নেমে গেলেও বাড়ির উঠানে পানি জমে আছে। এতে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। শিশুদের নিয়ে দুশ্চিন্তা বেশি, কখন পানিতে পড়ে বিপদ ঘটে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মনজুর আহমেদ জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত হাওড়া নদীর পানি ৯ সেন্টিমিটার কমেছে। এতে উন্নতি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতির। আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজালা পারভীন রুহি জানান, দুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে। পানি কমে গেলে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত করা হবে বলে তিনি জানান।
হবিগঞ্জে সাড়ে ১৪ হাজার পরিবার পানিবন্দি: কয়েকদিনের টানা বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হবিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা বন্যার কবলে পড়েছে। পানিবন্দি অন্তত ১৪ হাজার ৩৪০টি পরিবার। এখনও বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে নদ-নদীর পানি। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১২৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করেছে জেলা প্রশাসন। এসব আশ্রয়কেন্দ্রের বেশ কয়েকটিতে উঠেছেন বন্যাকবলিত পরিবারগুলো। সরেজমিনে দেখা যায়, মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে হবিগঞ্জে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছে। জেলার সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও প্রবল বর্ষণ হয়। বৃষ্টিপাতের ফলে জেলার খোয়াই, করাঙ্গি, কুশিয়ারা, ভেড়ামোহনাসহ অন্যান্য নদীর পানি বেড়ে গেছে। বুধবার থেকে এসব নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে। পানি ঢুকে পড়েছে লোকালয়ে। এদিকে জেলা সদরে শহরতলীর জালালাবাদ এলাকায় খোয়াই নদীর বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবল বেগে হাওরে পানি প্রবেশ করছে। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে রিচি, জালালাবাদ, ছোট বহুলা, সুলতান মাহমুদপুর, নোয়াগাঁওসহ আশপাশের গ্রামগুলো। ডুবে গেছে হাওরের বিস্তীর্ণ আমন ধানের জমি। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার ১৪ হাজার ৩৪০টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত এখন পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৫৬০ জন মানুষ। তাদের অনেকেই পরিবার পরিজন এবং গবাদি পশু নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র উঠেছেন।
লক্ষ্মীপুরে দুর্ভোগ বেড়েছে: লক্ষ্মীপুরে কমেছে ভারী বর্ষণ। ফলে সকাল ৮টার পর থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। তবে জলাবদ্ধতা হয়ে দুর্ভোগ বেড়েছে। কমলনগর, রায়পুর ও রামগতির বিভিন্নস্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে না। কোথাও কোথাও রোদ দেখা গেছে। আবার কোথাও গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে রামগতি, কমলনগর, রায়পুর, রামগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর সদরের একাংশে অন্তত ৬ লাখ মানুষ পানির কষ্টে রয়েছেন। অনেকের বসতঘর পানিতে ডুবে আছে। কমলনগরের চরকাদিরা ইউনিয়নের সর্বত্র এখন ৪ ফুট পানির নিচে। ভুলুয়া নদীর দক্ষিণ প্রান্তে আজাদনগর স্টিল ব্রিজ এলাকাসহ বিভিন্ন অংশ দখলের কারণে আশানুরুপভাবে পানি নামছে না। ভুলুয়া নদীর সঙ্গে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর ২০টি ইউনিয়নের মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। অবৈধ দখলদারের কারণে রহমতখালী ও ডাকাতিয়া নদীর পানি নামতেও বেগ পেতে হচ্ছে।
স্থানীয় পাউবো সূত্র জানায়, গতকাল শুক্রবার মেঘনা নদীতে সকাল সাড়ে ৭টার থেকে ভাটা চলছে। বিকেল ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত জোয়ার থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। জোয়ার সময় পাউবোর স্লুইস গেটগুলো বন্ধ রাখা হয়। এতে নদীর পানি ভেতরে ডুকে না। রামগতির চরপোড়াগাছা গ্রামের শেখের কিল্লা এলাকার বাসিন্দা ঝর্ণা বেগম ও আরিফ হোসেন বলেন, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে বাড়ির সামনেসহ আশপাশে কোমর পর্যন্ত পানি জমে আছে। একটুও পানি নামছে না। বাড়িতে হাঁটুপানি। আমাদের ঘরে আরও ৫টি পরিবারকে আশ্রয় দিতে হয়েছে। গত কয়েকদিন ইট বসিয়ে রান্না করতে হয়েছে। এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না। পানির কারণে আগুন জ্বলছে না। রায়পুরের খাসেরহাট নাইয়াপাড়া জেলে সমিতির সভাপতি মোস্তফা বেপারী বলেন, জমে থাকা পানি নদীতে নামছে। ভারী বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তবে সময় লাগবে। লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, লক্ষ্মীপুরে আর ভারী বৃষ্টি না হলে চলমান জলাবদ্ধতার সংকট ৩ দিনের মধ্যে কেটে যাওয়ার আশা করছি। লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুরাইয়া জাহান সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী ১৮৯টি সাইক্লোন শেল্টারগুলোও প্রস্তুত রয়েছে। অসহায় মানুষদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
নোয়াখালীতে মানুষের মানবেতর জীবন: টানা ভারী বৃষ্টি ও কুমিল্লা-ফেনী থেকে নেমে আসা ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নোয়াখালীর ২০ লাখ মানুষ। তাদের বেশিরভাগই খাবার ও বাসস্থানের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জেলার ৯ উপজেলার সবকটিতেই বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ছে লাখও মানুষ। খাল উদ্ধার ও পানি নিষ্কাশনে সেনাবাহিনীসহ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে তারা। জানা গেছে, সুবর্ণচর, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর ও সদর উপজেলার বেশিরভাগ নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক উচ্চতায় জোয়ার হয়েছে। ফলে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। এদিকে বুধবার রাতে বৃষ্টি বন্ধ থাকার পর বৃহস্পতিবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রবল বর্ষণে পানি বেড়ে যাওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে। শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
নোয়াখালী আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে আগামি ৪৮ ঘণ্টা ভারী বর্ষণ হতে পারে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা সাহাব উদ্দিন বলেন, রাস্তাঘাট ডুবে এখন মানুষের বসতঘরে পানি ঢুকেছে। মাছের ঘেরসহ সব ভেসে গেছে। এতো পানি ৬০ বছর বয়সে কখনো দেখিনি। বৃষ্টি হলে পানি নেমে যায় কিন্তু এবার পানি নামছে না। কবিরহাট উপজেলার বাসিন্দা রুবেল বলেন, হাঁটু পানি দিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের করেছে প্রভাবশালীরা। খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও খাল দখল করে বাড়িঘরও নির্মাণ করা হয়েছে। যার কারণে পানি নামছে না। সেনাবাহিনী এসব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিয়ে খাল পরিষ্কার করলে জলাবদ্ধতা থাকতো না। কবিরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র আলাবক্স তাহের টিটু বলেন, আজ (শুক্রবার) এলাকার এক ভাই মারা গেছে। বেলা ১১টায় তার জানাজা পড়ে দাফন করার কোনো জায়গা পাইনি। পরে আড়াই কিলোমিটার দূরে এক জায়গায় কোনমতে দাফন করেছি।
সুবর্ণচর উপজেলার হারিচ চৌধুরীর বাজার এলাকার বাসিন্দা ফারজানা আক্তার বলেন, টানা বৃষ্টিতে বাড়ির উঠানে পানি জমেছে। রান্নাঘরেও পানি। রান্নাও করতে পারিনি। টিউবওয়েলের পানিতে ময়লা আসে। আমরা অসহায় অবস্থায় আছি। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসাইন পাটোয়ারী বলেন, মুছাপুর, চরফকিরা এবং চরএলাহী ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন সব বাসিন্দারা অধিক ঝুঁকিতে থাকায় তাদেরকে নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ করেছি। অস্বাভাবিক জোয়ারে বাঁধ এবং তৎসংলগ্ন এলাকার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও জানমালের ক্ষতির কারণ হতে পারে। জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন বলেন, জেলার ৯ উপজেলার ৮৭ ইউনিয়ন ও পৌরসভা আক্রান্ত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষ প্রায় ১৯ লাখ ৮০ হাজার জন। এরমধ্যে ৩৮৮ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ৩৬ হাজার ১১৫। পানিবন্দি এলাকায় ৮৮টি মেডিকেল টিম খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছে।
তথ্য ও সহযোগিতার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ০২৫৫১০১১১৫ নম্বরে ফোন করা যাবে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করার কথা জানিয়েছে। দুর্গতদের ০১৩৩১৮২৩৪৯৬২, ০১৭৬৫৪০৫৫৭৬, ০১৫৫৯৭২৮১৫৮ ও ০১৬৭৪৩৫৬২০৮ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ করতে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। সহায়তার প্রয়োজন হলে ফোন করা যাবে ০১৩১৮২৩৪৫৬০ নম্বরে।
আর বন্যার মধ্যে টেলিযোগাযোগ সেবা সচল রাখতে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করার কথা জানিয়েছে বিটিআরসি।
বিটিআরসির ইমার্জেন্সি রেসপন্স দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে +৮৮০২২২২২১৭১৫২ নম্বরে ফোন করতে হবে। বিটিআরসির কল সেন্টার ১০০ ব্যবহার করেও ওই দলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স
প্রতিবেদকের তথ্য

সর্বশেষ সংবাদ