ঢাকা , বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫ , ১৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
সবাই মিলে রাষ্ট্র বিনির্মাণের সুযোগ হয়েছে-আলী রীয়াজ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বদলিতে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য ১৭ অভিনয়শিল্পীর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলার আবেদন রাস্তায় অভিনেতাকে সিদ্দিককে গণপিটুনি কারিগরি শিক্ষার্থীরা যা শিখছেন, চাকরির বাজারে তার চাহিদা নেই -সিপিডি আগামী নির্বাচনে সীমিত পরিসরে হলেও প্রবাসীদের ভোটের প্রস্তুতি চলছে : সিইসি জনবান্ধব পুলিশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে-স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুলিশকে উজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব জমা দিতে গড়িমসি অপকর্ম বন্ধ করুন, নইলে বিএনপিকেও জনগণ ছুড়ে মারবে -নেতাকর্মীদের ফখরুল সভ্য হতে হলে প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে হবে : এনবিআর চেয়ারম্যান বইপ্রেমী এক ডিসির গল্প গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে চিকিৎসাধীন অন্তঃসত্ত্বার মৃত্যু গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ দুই বোন ই-৮ ভিসায় দক্ষিণ কোরিয়ায় গেলেন ২৫ কর্মী পুলিশের জন্য ১৭২ কোটি টাকায় কেনা হবে ২০০ জিপ সামাজিক সুরক্ষায় যুক্ত হচ্ছে আরও ৬ লাখ ২৪ হাজার উপকারভোগী ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনে লিপ্ত থাকার অভিযোগ গ্যাস খাতে বছরে আর্থিক ক্ষতি বিলিয়ন ডলার নতুন লুকে নজর কাড়লেন ব্লেক লাইভলি

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা

  • আপলোড সময় : ৩১-১০-২০২৪ ০৯:৫৮:২৯ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ৩১-১০-২০২৪ ০৯:৫৮:২৯ অপরাহ্ন
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা

* শত কোটি টাকার বিদ্যুৎ প্রকল্পে হয়েছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি
* ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফায়
* রেন্টালের ঘাটতি পূরণে দরকার টেকসই বিদ্যুৎকেন্দ্র


বিগত আওয়ামী লীগ সরকার মাঝারি ও বড় সক্ষমতার কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল দেড় দশক আগে। দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলেও যথাসময়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। শত শত কোটি টাকার এসব প্রকল্পের অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে ওপেন সিক্সেট। অপর দিকে প্রকল্পের নয় ছয়ের কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরে ধ্বস নেমে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদার জোগান দিতে ৩-৫ বছর মেয়াদি চুক্তিতে ২০১১-১২ সালে উৎপাদনে আসা দ্রুত ভাড়াভিত্তিক (কুইক রেন্টাল) ও ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। দ্বাদশ সংসদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার কমিটির এক বৈঠকে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ আর না বাড়াতে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছিলেন। তবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়িত না হওয়ায় ভাড়াভিত্তিক কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবে পায়রা, রামপালের মতো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসার পর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বন্ধ করে দেয়ার সময় এসেছে বলে আভাস দিতে শুরু করে বিদ্যুৎ বিভাগ। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করাও হয়। তবে রামপাল প্রত্যাশা অনুযায়ী উৎপাদনশীল না হওয়ায় চাহিদার ঘাটতি রয়েই যায়। এতে রেন্টাল কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ পুনরায় বাড়ানো হয়।
কয়েক মাস আগেও সামিট, ওরিয়নসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ায় তৎকালীন সরকার। রেন্টাল-কুইক বিদ্যুতের উচ্চ দামের কারণে পিডিবির হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসানের বিষয়ে সমালোচনা আছে। লোকসান পোষাতে বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগণের ‘পকেট কাটা’ হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে গঠিত বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) পটুয়াখালীর পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা-তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মালিকানায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সমান (৫০:৫০) অংশীদারত্ব রয়েছে। পায়রার প্রথম ইউনিটটি ২০২০ সালের ১৫ মে এবং দ্বিতীয় ইউনিটটি একই বছর ৮ ডিসেম্বর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। আর রামপালের প্রথম ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসে ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর এবং দ্বিতীয় ইউনিটটি আসে ২০২৪ সালের ১২ মার্চে।
বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে গঠিত বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) অধীনে ১৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট (রামপাল) নামে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হয়। কেন্দ্রটিতে বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রীয় দুই বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানের সমান (৫০:৫০) অংশীদারত্ব রয়েছে।
এরপর উৎপাদনে আসে কক্সবাজারের মহেশখালীতে নির্মিত মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মিত এস আলমের ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে মাতারবাড়ীর প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে যথাক্রমে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০২৪ সালের জুলাইয়ে। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়ন এবং রাষ্ট্রীয় কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) অধীনে এই কেন্দ্রটি নির্মিত হয়।
ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে নির্মাণ করে ১৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। দ্বিতীয় ইউনিটটি রয়েছে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য বেরিয়ে এলে জটিলতায় পড়ে এস এস পাওয়ার। বিদ্যুৎকেন্দ্রেটির এলসি আটকে যাওয়ায় কয়লা আমদানিতে সংকট তৈরি হয়।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সাসটেইনেবল যদি ধরি তাহলে পায়রা। উৎপাদন বিবেচনায় এটি দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতার বিচারেও সফল। এটি আমাদের গ্রিডে নির্ভরযোগ্য অবদান রাখছে। অধিকাংশ সময় সক্ষমতার পুরো বিদ্যুৎ আমরা পায়রা থেকে নিচ্ছি, যা মোট চাহিদার দশ শতাংশ বলতে পারেন। ডলার সংকটে কয়লার বিল পরিশোধে কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় একবার পায়রার উৎপাদন কিছুদিন বন্ধ ছিল। তখন বোঝা গেছে কেন্দ্রটির অবদান। লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছিল।
রামপাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের আশা ছিল এই কেন্দ্রটিও বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। কিন্তু তা হয়নি। একে তো এটি উৎপাদনে এসেছে অনেক দেরি করে। তার ওপর কখনো ইলেকট্রিক্যাল প্রোটেকশন সিস্টেমে ত্রুটি, কখনো বয়লারের টিউব ফেটে যাওয়া, কুলিং হিটারে ছিদ্রসহ কারিগরি নানা কারণে এটি অন অফের মধ্যে রয়েছে। জ্বালানি সংকট তো রয়েছেই। ফলে প্রত্যাশা অনুযায়ী সর্ভিস পাওয়া যাচ্ছে না রামপাল থেকে।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং এস আলমের এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুটোই নতুন, সবেমাত্র এসেছে। অবজারভেশন করতে হবে। একটার নির্মাতারা তো আবার মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে বেকায়দায়। একটা নির্দিষ্ট সময় পর বলা যাবে এগুলো কতটুক সাসটেইনেবল। এ কর্মকর্তা আরো বলেন, রামপাল, মাতারবাড়ী, এসএস পাওয়ার যদি পায়রার মতো সাপোর্ট দিতে পারে তাহলে রেন্টাল সবই বন্ধ করে দেয়া যাবে।
গরমের দিন এবং সেচ মৌসুমে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১৬-১৭ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছালেও অন্যান্য সময় দৈনিক গড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াটের মতো চাহিদা থাকে। এটি কখনো সাড়ে ১১ হাজারে নেমে যায় আবার কখনো সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াটেও উঠে। যদিও শীতকালে এই চাহিদা ৭-৯ হাজার মেগাওয়াটে ওঠা-নামা করে। কয়লাভিত্তিক বড় চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারলে গরমের সময়ও দেশে দৈনিক মোট চাহিদার প্রায় ৩৩ শতাংশ পূরণ হওয়ার কথা। পিডিবির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কারিগরি ত্রুটি, জ্বালানি সংকটসহ নানা জটিলতায় অন্য তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ধারাবাহিক উৎপাদন ব্যাহত হলেও পায়রা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) তথ্য অনুযায়ী, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র দৈনিক গড়ে ১২০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। যা গড়ে দেশের দৈনিক মোট চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ।
বিভিন্ন সময় এনএলডিসির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পায়রা থেকে পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ ১২৪৪ মেগাওয়াট এবং অফ-পিক আওয়ারে ১২০০ মেগাওয়াট বা কখনো এর চেয়ে কিছু কম বিদ্যুৎ নিয়েছে পিডিবি। এতে আরো দেখা যায়, গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহে অবদান বিবেচনায় পায়রার তুলনায় অন্য তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পিছিয়ে আছে।
আইপিপি, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে গত এক যুগে মেয়াদোত্তীর্ণ ফার্নেস তেলভিত্তিক ৭৫৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৯টি এবং গ্যাসভিত্তিক ৫৫৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ডিজেলভিত্তিক মোট ১৪০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১২টি, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক মোট ৩৮০ মেগাওয়াট ক্ষমতার চারটি এবং গ্যাসভিত্তিক মোট ৬১৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটিসহ সর্বমোট ২৩৯৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৪টি আইপিপি, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অবসর দেয়া (বন্ধ করা) হয়েছে। এর মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে এমন কেন্দ্রও রয়েছে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংস্কার: সিপিডির প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন করে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ না বাড়ানোর দাবি জানায়।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের দেশে ৪০ শতাংশ উদ্ধৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্যাপাসিটি আছে। নতুন করে আর এক মেগাওয়াট যুক্ত না হলেও ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতে ঘাটতি হবে না। তাই রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও লো-ইফিশিয়ান্ট বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়া দরকার।
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ