সম্প্রতি ভারতশাসিত কাশ্মীরে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়েছে। গত ২২ এপ্রিল পহেলগামের বৈসরণ উপত্যকায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ২৬ পর্যটকের মৃত্যু হয়। ওই হামলার জন্য নয়াদিল্লি শুরু থেকেই ইসলামাবাদকে দোষারোপ করে আসছে, যদিও এ বিষয়ে তারা কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা উত্তরোত্তর কেবল বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত মঙ্গলবার রাতভর জম্মু ও কাশ্মীরের আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী পারগাওয়াল সেক্টরে পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষী বাহিনী গোলাগুলি হয়েছে। যুদ্ধের দোরগোড়ায় পাক-ভারত।
জানা গেছে, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামের বৈসরণ উপত্যকায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ২৬ পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনায় পাকিস্তান শুরু থেকেই ভারতের এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু ভারত থেমে নেই। কোনো ধরনের প্রমাণ না থাকলেও তারা ইসলামাবাদকেই পহেলগামে হামলার জন্য দোষী করে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভারত সরকার সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত, প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধসহ একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে সীমান্তের একদিকে যেমন ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের’ দাবি জোরালো হয়েছে তেমনই অন্যপ্রান্তে ‘সমুচিত জবাব’ দেয়ার দৃঢ সংকল্পও নেয়া হয়েছে।
ভারতশাসিত কাশ্মীরের অনন্তনাগ পুলিশ এ ঘটনায় সন্দেহভাজন হামলাকারীদের স্কেচ প্রকাশ করেছে। এদের মধ্যে দু’জন পাকিস্তানি নাগরিক রয়েছেন বলেও অভিযোগ তোলা হয়েছে। তবে প্রমাণের অভাবে প্রথাগত ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে নানারকম জল্পনা-কল্পনা চলছে। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য সেগুলোকে আরও উসকে দিচ্ছে।
এরই মধ্যে কাশ্মীরে ওই ভয়াবহ হামলার প্রতিশোধ নিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সামরিক বাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার চলমান পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মোদী উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক করেন। সেখানে তিনি পহেলগাম হামলার জবাবের ধরন, লক্ষ্যবস্তু ও সময় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেন।
নরেন্দ্র মোদী বলেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করা আমাদের জাতীয় সংকল্প এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর তার পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। ওই বৈঠকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ও চিফ অব স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহানও অংশ নেন। ভারতের সামরিক বাহিনীকে মোদীর পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের ঘোষণার পর গতকাল বুধবার পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেন, পাকিস্তানের কাছে বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যে, ভারত পহেলগামে হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট অভিযোগের অজুহাতে আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘন্টার মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান এই অঞ্চলে ভারতের এমন আগ্রাসী ভূমিকা এবং বেপরোয়া আচরণকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান নিজেই সন্ত্রাসবাদের শিকার এবং এই অভিশাপের যন্ত্রণা সত্যিই তারা জানে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা বিশ্বের যে কোনো স্থানে এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছি। তিনি বলেন, একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান এই হামলার সত্যতা নিরূপণের জন্য বিশেষজ্ঞদের একটি নিরপেক্ষ কমিশন দ্বারা বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ এবং স্বাধীন তদন্তের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, যুক্তির পথ অনুসরণ করার পরিবর্তে ভারত স্পষ্টতই অযৌক্তিকতা এবং সংঘাতের বিপজ্জনক পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পরিণতি এই অঞ্চল এবং তার বাইরেও বিপর্যয় ডেকে আনবে। তিনি ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ভারতের এ ধরনের সামরিক অভিযানের জবাব নিশ্চিতভাবে এবং চূড়ান্ত আকারে দেয়া হবে।
এদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ও পাবলিক অ্যাফেয়ার্সবিষয়ক উপদেষ্টা রানা সানাউল্লাহ খান বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আবারও নির্বাচন সামনে রেখে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাবকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।
পুলওয়ামা থেকে বর্তমান পর্ব পর্যন্ত তিনি (মোদী) জনগণকে বিভ্রান্ত করতে এবং নির্বাচনী সুবিধা অর্জনের জন্য বারবার নাটক মঞ্চস্থ করছেন বলেও অভিযোগ করেন রানা সানাউল্লাহ খান। তবে শাহবাজ শরিফের এই উপদেষ্টা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, মোদী ছোটখাটো উসকানি বা কৌশল অবলম্বন করতে পারলেও তিনি পারমাণবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার অবস্থানে নেই। কোনো সন্দেহ নেই যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে কোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর, চূড়ান্ত ও উপযুক্ত জবাব দেয়া হবে বলেও জানান। রানা সানাউল্লাহ খান আরও বলেন, যে কোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে এ ব্যাপারে সমগ্র জাতি একমত। পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যেই ফ্রান্সের কাছ থেকে ২৬টি রাফায়েল-মেরিন যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত। এই চুক্তির বিষয়ে সে দেশের সঙ্গে কথাবার্তা আগেই চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে এমন একটা সময় যখন পহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনা তুঙ্গে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ৭৪০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করে ফ্রান্স থেকে যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত। এই যুদ্ধবিমান আইএনএস বিক্রান্ত থেকে পরিচালিত হবে। পুরোনো যুদ্ধবিমানগুলোকে ধীরে ধীরে সরিয়ে এই আধুনিক যুদ্ধবিমান ব্যবহার করার কথা ভাবছে ভারত। এখন প্রশ্ন হলো ভারত কী তবে পাকিস্তানে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বা পাকিস্তানের হামলা মোকাবিলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও ?জোরদার করছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক রাফায়েল চুক্তি ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তোলার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র সাংবাদিক কমার আঘা বলেন, এই চুক্তি ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে মজবুত করে তুলবে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর কাছে এরই মধ্যে রাফায়েল যুদ্ধবিমান রয়েছে। এখন নৌবাহিনীর কাছেও তা থাকবে। যুদ্ধবিমান ভারতে আসতে এবং ব্যবহার শুরু হতে আরো কয়েক বছর লাগলেও এই চুক্তি স্বাক্ষর করা একাধিক কারণে বিশেষ ইঙ্গিত বহন করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে রাফায়েল চুক্তির পেছনে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী ভাবনা রয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার কী আরও একবার আন্তঃসীমান্ত পদক্ষেপের কৌশল গ্রহণ করতে পারে? তা যদি হয়, তাহলে তার জবাবে পাকিস্তানের তরফে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? তবে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখে নেয়া যাক ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
২২ এপ্রিল পহেলগামে হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সিমলা চুক্তি স্থগিত, সীমান্ত বন্ধ করা, বাণিজ্য স্থগিত, ভারতের উপর পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি ভারতের নেয়া সিন্ধু পানি বন্টন চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে।
এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ভারত যদি এই চুক্তি থেকে সরে এসে পাকিস্তানের দিকে পানির প্রবাহ বন্ধ করে বা পানি অন্যদিকে চালিত করার চেষ্টা করে তাহলে তা যুদ্ধের পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। পূর্ণ শক্তি দিয়ে এর জবাব দেয়া হবে বলে জানিয়েছে পাকিস্তান।
যুদ্ধ, সংকট ও উত্তেজনা সত্ত্বেও ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে সিন্ধু পানি বন্টন চুক্তি বহাল ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ভারতের এই চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত একটা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে-যে ‘চাপ সৃষ্টি’ করতে ‘পানির মতো মৌলিক সম্পদ ব্যবহার করতে প্রস্তুত’ তারা। এই সিদ্ধান্তকে ‘বিপজ্জনক পদক্ষেপ’ হিসেবে মনে করছেন কেউ কেউ। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকের পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বারবার দাবি করেছেন, ভারতের পক্ষ থেকে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে তিনি এও দাবি করেছেন যে, তার কাছে এমন তথ্য রয়েছে যে আগামী দিনে বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় সশস্ত্র কর্মকাণ্ড বাড়াতে ভূমিকা পালন করতে পারে ভারত। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জানিয়েছেন, এমনটা ঘটলে পাকিস্তান তার কড়া জবাব দেবে এবং প্রত্যেক নাগরিকের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে এই বাকযুদ্ধ এবং পাল্টাপাল্টি দোষারোপের এমন পরিস্থিতিতে এই শঙ্কা দেখা দিয়েছে যে দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ কী আসন্ন? তারা কী আসলেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে?
এদিকে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা উত্তরোত্তর কেবল বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত মঙ্গলবার রাতে জম্মু ও কাশ্মীরের আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী পারগাওয়াল সেক্টরে পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষী বাহিনী গুলি চালিয়েছে বলে দাবি করছে ভারত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, বিগত কয়েক দিনে নিয়ন্ত্রণরেখার (লাইন অব কন্ট্রোল) শর্ত একাধিকবার ভেঙেছে পাকিস্তান। গত মঙ্গলবার রাতে জম্মু এলাকার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে তারা। ভারতীয় বাহিনী তার পাল্টা জবাব দিয়েছে। এর আগে, নিয়ন্ত্রণরেখাজুড়ে পাকিস্তান বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছিল বলে অভিযোগ করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাদের দাবি, পাকিস্তানের গুলির সমুচিত জবাব দেয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণরেখা ভিন্ন বিষয়। আন্তর্জাতিক সীমান্ত হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সীমারেখা। আর নিয়ন্ত্রণরেখা মূলত একটি অস্ত্রবিরতি রেখা। এটি দু’দেশের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে শান্তিরক্ষার উদ্দেশ্যে নির্ধারিত হয়েছে। এই রেখা বরাবর গোলাগুলি চালানো চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে।
এই পরিস্থিতিতে ইন্দাস নদী পানিবণ্টন চুক্তি এবং পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা পরিষেবা স্থগিত করেছে দিল্লি। একইসঙ্গে ভারতে দায়িত্বরত পাকিস্তানি কূটনীতিকদের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে এবং সব পাকিস্তানি নাগরিককে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান জানিয়েছে, তারা শিমলা চুক্তিসহ সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাতিল করবে।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। কাশ্মীরে হামলার ঘটনা জানামাত্রই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলেছেন তিনি। জাতিসংঘের বিবৃতিতে বলা হয়, কাশ্মীরে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন গুতেরেস। সব পক্ষকে সতর্ক করে তিনি বলেন, আইন মেনে হামলাকারীদের জবাবদিহি ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ভারত ও পাকিস্তানের কোনও সংঘর্ষে জড়ানো উচিত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, সংঘর্ষের ফলে কেবল গভীর মানবিক সংকট সৃষ্টি হবে।
দু’দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি ইঙ্গিত করছে যে এই সংকট এখন আরও বাড়বে। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বিবিসিকে জানিয়েছেন, ভারত ও পাকিস্তান মারাত্মক সংকটের দিকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, পহেলগাম হামলায় বেসামরিক মানুষের মৃত্যু এবং এর জবাবে ভারতের লক্ষণীয় সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করা প্রমাণ করে যে পরিস্থিতি আর মধ্য স্তরের উত্তেজনায় সীমিত নেই। সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ও থিংক ট্যাঙ্ক স্টিমসন সেন্টারের পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ থারলকেল্ড বলেন, পহেলগামে হামলার পর সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু তা কখন এবং কীভাবে হবে সেটা স্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, ভারতের যে কোনো হামলায় পাকিস্তান অবশ্যই জবাব দেবে এবং দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে, যেখানে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দুই দেশের মধ্যে কারও কাছে পরিষ্কার নাও হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে দুই দেশ যুদ্ধের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে এমন ঘটনা নতুন নয়। গত ২৫ বছরে ভারত এবং পাকিস্তান বেশ কয়েকবার একেবারে যুদ্ধের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে।
২০০১ সালে সংসদে হামলার পর ভারত পাকিস্তানি বিমানের জন্য নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সীমান্তে দুই দেশই নিজেদের বাহিনী মোতায়েন করে। একইভাবে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর ব্যাপক উত্তেজনার পর সীমান্তে একই চিত্র দেখা যায়। এরপর ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় হামলার জবাবে ভারতীয় বিমানবাহিনী বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ভারতীয় বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করে এবং বিমানচালককে আটক করে। এত কিছুর পরেও প্রচলিত যুদ্ধ বলতে ঠিক যা বোঝায় তা দেখা যায়নি। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এবারের পার্থক্য হলো, কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি পানির মতো ‘মৌলিক’ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভারতের পক্ষ থেকে অতি দ্রুত পদক্ষেপ দেখা গেছে এবং আমি মনে করি তাদের (ভারতের) পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেটা দেখার জন্য আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক পদক্ষেপ নিলে পাকিস্তান যে কড়া জবাব দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তারা বলছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে একদিকে ভারতীয় নেতৃত্বের ওপর জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চাপ তৈরি হচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো- সেখানকার মিডিয়া ও রাজনীতি পাকিস্তানকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। অন্যদিকে ভারতের কর্মকাণ্ডের কড়া জবাব দিতে পাকিস্তানের নেতৃত্বের ওপরেও চাপ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তান যদি আগামী দুই দিনের মধ্যে বিশ্বশক্তির পক্ষ থেকে ভারতের ওপর কূটনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে সফল হয়, তাহলে তা (পাকিস্তানের কাছে) সর্বোত্তম বিকল্প হবে। এতে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হওয়া থেকেও রেহাই পাবে।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠাকে কেন্দ্র করে যে সব প্রশ্ন উঠছে, তার মধ্যে একটা হলো এই পরিস্থিতি প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে কী না। এমন প্রশ্নের জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, তার বিশ্বাস ভারত-পাকিস্তান নিজেরাই এই পরিস্থিতির সমাধান খুঁজে বের করতে পারবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, আমি ভারতের খুব কাছের এবং আমি পাকিস্তানেরও খুব কাছের। পর্যটকদের লক্ষ্য করে চালানো হামলার নিন্দা করে তিনি বলেন, একটা বাজে আক্রমণ হয়েছে। তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন যে, দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে উত্তেজনা দীর্ঘদিনের। তার মতে, পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে অনেক উত্তেজনা রয়েছে, কিন্তু এটা বরাবরই ছিল। ভারত এবং পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্ব সমাধান খুঁজে বের করতে পারবে বলে তিনি মনে করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, আমি নিশ্চিত যে তারা কোনভাবে এটার একটা সমাধান খুঁজে বের করবে। আমি দুই দেশের নেতাকেই চিনি।
তবে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্কটের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই অনুমান করেছিলেন। এলিজাবেথ থারলকেল্ড আগেই বিবিসিকে বলেছিলেন, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সঙ্কট ব্যবস্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র হয়তো কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না। কারণ ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক গভীর হচ্ছে এবং পাকিস্তানের ওপর আমেরিকার প্রভাব কমছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন পররাষ্ট্রনীতির ফ্রন্টে একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র একটা কার্যকর মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম নাও হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে-‘দু’দেশ উত্তেজনার সবচেয়ে বিপজ্জনক অধ্যায়’ পেরিয়ে গিয়েছে কী না? এই প্রশ্ন ওঠার কারণ অতীতে উরি ও পুলওয়ামায় হামলার পর ভারত যে কৌশল অবলম্বন করেছিল। দুই ক্ষেত্রেই ভারত সরকারের নির্দেশে আন্তঃসীমান্ত অভিযান চালানো হয়েছিল। এসব পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। পুলওয়ামার ঘটনার পর ভারত বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ পাকিস্তান পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। সে সময় ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিমান ধ্বংস এবং ভারতীয় পাইলটকে আটক করে পাকিস্তান। তখন দুই দেশের মধ্যে বড়সড় আকারের সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ায় দু’দেশের মধ্যে এই সংঘাত এবং উত্তেজনা আর বাড়বে না। সাবেক সিনেটর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুশাহিদ হুসেন সৈয়দ বলেন, ভারত অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পুলওয়ামার পরে, যখন সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, তখন পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া খুব শক্তিশালী ছিল, যা কূটনৈতিক ফ্রন্টে ভারতের ক্ষতি করেছিল। তিনি বলেন, আমি মনে করি সামরিক পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকবে ভারত। তারা তাদের সব গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক কার্ড এরই মধ্যে খেলে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমের বিলাল সোফি বিবিসির সঙ্গে আলোচনার সময় আশা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা হয়তো আর বাড়বে না। তিনি বলেছেন, আশা করি, ভারতের ঘোষণাগুলো প্রতীকী থাকবে এবং আগামী বছরগুলোতে প্রকৃতপক্ষে পানি বন্টণ বন্ধ হবে না। তবে যদি এমনটা করার চেষ্টা করা হয় তবে তা অবশ্যই প্রথাগত যুদ্ধের দিকে একটা বড় পদক্ষেপ হবে।
কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফটের বিশ্লেষক অ্যাডাম ওয়েনস্টেইন বিবিসি উর্দুকে বলেন, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনো ধরনের প্রথাগত যুদ্ধ বা পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার কারণে যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে চিন্তিত। তবে তিনি বলছেন, কাশ্মীরে হামলা পরিকল্পিত হোক বা না হোক পশ্চিমা সরকারগুলো ভারতকে পুরোপুরি সমর্থন করার আগে (এই হামলায় বিদেশি উপাদানের জড়িত থাকা) প্রমাণ চাইবে। তা সে যতই ভারতের প্রতি পশ্চিমাদের সহানুভূতি থাকুক না কেন। তার মতে, এতে পাকিস্তানের অস্তিত্ব হুমকির মুখে না পড়লেও ?সিন্ধু পানি চুক্তি সংক্রান্ত বিরোধকে তা আরও বাড়িয়ে তুলবে। ওয়েনস্টেইন বলেন, তাদের ভারত বিরোধী বা কাশ্মীর সংক্রান্ত বক্তব্য জাতীয় স্বার্থকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে বা পাকিস্তানকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে কী না সেটাও পাকিস্তানি নেতাদের ভাবতে হবে। দুই দেশের উত্তেজনা এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, দুই দেশই আবার একটা আবর্তের মধ্যে পড়বে। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে এবং তারপর একসময় পরিস্থিতি আবার আগের মতো হয়ে যাবে। তার মতে, এসব বিষয় নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে দুই দেশই তাদের নিজেদের অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধির মতো বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করতে পারবে না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* সাজ সাজ রব উভয় সীমান্তে * ভারী অস্ত্রসস্ত্র মোতায়েন, বিমানবাহিনীর টহল জোরদার * সীমান্তে রাতভর ব্যাপক গোলাগুলি
যুদ্ধের দোরগোড়ায় পাকিস্তান-ভারত
- আপলোড সময় : ০২-০৫-২০২৫ ১২:০২:৪৭ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০২-০৫-২০২৫ ১২:০২:৪৭ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ