দেশে স্বর্ণের দাম বাড়ার পাশাপাশি বেড়েই চলেছে স্বর্ণপাচারও। বিভিন্ন এয়ারলাইনসে করে প্রায় প্রতিদিনই অবৈধভাবে স্বর্ণের চালান আসছে বাংলাদেশে। হযরত শাহজালালসহ তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করছে চোরাচালানিরা। অপর দুটি বিমানবন্দর হচ্ছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিভিন্ন কৌশল নিয়েও তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। স্বর্ণপাচার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই সিন্ডিকেটগুলো শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণের চালান পাচার করছে। ওইসব জায়গায় তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কও রয়েছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে দেশের কিছু জুয়েলারি দোকান মালিকদেরও। রাজনৈতিক কানেকশনও আছে। বিমান ও সিভিল অ্যাভিয়েশনের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীও চোরাকারবারিদের সহায়তা করছে। প্রকৃত চোরাকারবারিদের ধারে-কাছেও ভিড়তে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ফলে বড় চালান ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
কাস্টমস ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, যত স্বর্ণ ধরা পড়ছে, তার কয়েক গুণ বেশি পাচার হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্বর্ণ চোরাচালানে নিত্যনতুন কৌশল ও পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। চোরাকারবারিরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই থেকে স্বর্ণ এনে বাংলাদেশ ও পাশের দেশগুলোর বাজারে সরবরাহ করছে। এতে বিমানবন্দরে কর্মরত ব্যক্তিদের যোগসাজশ রয়েছে।
গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চোরাচালানের সঙ্গে কারা সম্পৃক্ত। আন্তর্জাতিক একাধিক চক্রও বাংলাদেশে সক্রিয়। তারা বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করে। বাংলাদেশিরা তো রয়েছেই, এছাড়া ভারত, দুবাই, পাকিস্তান, সৌদি-আরব, চীন, মালয়েশিয়াসহ অন্তত ১০টি দেশের মাফিয়ারা এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত। তাদের কেউ কেউ আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দফতর এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর একটি তালিকা করেছে। এপ্রিল মাসে ২০৯ জনের নামের ওই তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশনস) রেজাউল করিম বলেন, সোনাসহ সব ধরনের চোরাচালান বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। দেশি হোক আর বিদেশি হোক-কেউ রেহাই পাচ্ছে না। সারা দেশেই পুলিশ নজরদারি করছে। বিমানবন্দরেও পুলিশ সক্রিয় রয়েছে চোরাকারবারিদের ধরতে। তালিকা ধরে আমরা কাজ করছি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক দিন ধরেই হযরত শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড চলে আসছে। কর্তৃপক্ষ কৌশল নিয়েও সফল হতে পারছে না। বিমানবন্দরগুলোতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের শীর্ষে রয়েছে স্বর্ণপাচার। আগের চেয়ে স্বর্ণপাচার বেড়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিন ধরা পড়ছে সোনার চালান। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ নিয়ে বিশেষভাবে তদন্ত করেছে। তারা নিশ্চিত হয়েছে বিদেশি এজেন্টদের পাশাপাশি দেশি এজেন্টরা বেপরোয়াভাবে সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা বাংলাদেশিদের সঙ্গে আঁতাত করে পাচার করছে সোনা।
বাংলাদেশে সক্রিয় মাফিয়াদের একটি তালিকা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সোনা পাচারকারী। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দীর্ঘদিন ধরেই সোনা পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাচার করার সময় সোনার বারসহ আটক হচ্ছে কারবারিরা। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হচ্ছে। কিন্তু কাউকে আটকে রাখা যাচ্ছে না। কোনো কোনো আসামি জামিন নিয়ে লাপাত্তা। তাদের কেউ দেশেই আত্মগোপনে রয়েছে, কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত ও উদ্ধার হওয়া সোনার বিষয়গুলো সুরাহা হচ্ছে না। আবার বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে।
পুলিশ ও কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, শুল্ক ফাঁকির এমন তৎপরতা আগে চোখে পড়েনি। পাচারের আগে লাগেজ, শরীর কিংবা ফ্লাইটের সিট ব্যবহার করা হতো। এখন রোগী সেজে, কিংবা সোনা গুঁড়ো করে ভিন্ন পদার্থ হিসেবে উল্লেখ করে পাচার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আমাদের নজরদারি অনেক বেড়েছে। তারা বলেন, আন্তর্জাতিক চক্রগুলো বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে।
পুলিশ ও শুল্ক গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক বছর আগে ১২ কোটি টাকা মূল্যের সোনাসহ ধরা পড়েন জাপানি নাগরিক তাকিও মিমুরা ও চীনা নাগরিক জু জিয়াং। তবে তারা জামিন নিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে গিয়ে আবারও একই কারবার চালাচ্ছেন। তারা কলকাতার আমির খানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সোনা পাচারে ব্যস্ত। আমির খানও বাংলাদেশ পুলিশের কাছে একবার ধরা পড়েছিলেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতের ঈশ্বর দাস, সৌরভ মণ্ডল, রমেশ কুমার ভার্মা, সালেকিন শেখ, সৌমিক দত্ত, কুলদীপ সিং, ওয়াসিম, দুবাইয়ের রমজান আলী, পাকিস্তানের আরশাদ আয়াজ আহমেদ, ভারতের গুজরাট সিং, প্রকাশ, রেখা, উর্মিলা কুমার, অনিক কুমার, বিনোদ কুমার, গুরজন্ত সিং, বিজয় কুমার, দিনেশ, পাকিস্তানের রাশেদ মো. খালেদ, চীনের চেন সিম ফাত, চেন জিলা, দিং শোশেং, জু ইয়ংগাং, লুতেংচেং, জাপানের শুইচি সাতো, মালয়েশিয়ার চ্যান গি কিউনগ, রাজা বসলিনা বিনতি, ক্যামেরুনের নোগোমবি বাছি, নাইজেরিয়ার নন্দিকা ক্লিনেন্ট, ক্লেটাস আছুনা, ওইউকুলভ টিমটি, একিন উইসডোম, দক্ষিণ আফ্রিকার চিগোজি, ইভুন্ডে গ্যাব্রিল ওবিনা, স্যালেস্টাইন প্যাট্রিক, মর্দি ন্যামডি, ওরদু চুকওরদু সাম্মি, ডুবুওকন সোমায়ইনা, জেয়েরেম প্রেসিয়াস, ভারতের রূপসাহা, গোপাল বিজন, বিজন হালদার, লক্ষণ সেন, গোবিন্দ বাবু, লালু জয়দেব, গওহর প্রসাদ, সঞ্জিব, রামপ্রসাদ, মিন্টু, সুমন চ্যাটার্জি, রিয়াজ, তপন সাহা, ডালিম, মোনায়েম, ফারুক, বসাক চ্যাটার্জি ও স্বপন সাহা, বাংলাদেশের দিনাজপুরের সোহেল রানা, নরসিংদীর মনির আহম্মেদ, নারায়ণগঞ্জের ওয়ায়েদউল্লাহ ও মঞ্জুর হোসেন, ঢাকার মিরপুরের সাইফুল ইসলাম, পল্লবীর সামসুল হুদা, মুন্সীগঞ্জের ইসলাম শেখ ও মোহাম্মদ রুবেল, রাজবাড়ির মোহাম্মদ হানিফসহ ২০৯ জনের সিন্ডিকেট সোনা পাচারে জড়িত।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসে করে সোনা পাচার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কেবিন ক্রু থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারীরা পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, গ্রেফতার হওয়া কেবিন ক্রু রোকেয়া শেখ মৌসুমী দীর্ঘদিন সোনা পাচার করে আসছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সৌদি এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু ফারজানা আফরোজ ও সায়মা আক্তারও একই কারবার করেছেন। বিদেশ থেকে আসার পর লাগেজ বা শরীর তল্লাশি না হওয়ার সুযোগে তারা এসব অপকর্ম করেন। এ ছাড়াও বিদেশি এয়ারলাইনসের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তাদের তালিকা তৈরিসহ নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ, ভারত, সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া, দুবাইসহ কয়েকটি দেশে সোনা কারবারিদের সিন্ডিকেট রয়েছে। ওই সব সিন্ডিকেটে বাংলাদেশি সদস্যও আছে।
ঢাকা কাস্টম হাউজের কমিশনার মুহম্মদ জাকির হোসেন বলেন, অবৈধ পণ্য ও সোনা ধরা পড়ছে। এ কারণে আমাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সব কর্মকর্তাকে বলে দেয়া হয়েছে, অবৈধ পণ্য যেন কোনোভাবেই বের হতে না পারে। কর্মকর্তারা নির্দেশ মতো দায়িত্ব পালন করছেন। কাস্টমসের প্রতিটি টিমের কর্মকর্তা সর্বোচ্চ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। গোয়েন্দা সোর্স আরও বাড়ানো হয়েছে। বিমানবন্দরে অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তারাও সোনা পাচারকারীদের ধরার চেষ্টা করছেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* তিন বিমানবন্দর ঘিরে চোরাচালানের সাথে জড়িত দেশি-বিদেশি চক্র * বিভিন্ন এয়ারলাইনসে করে প্রতিদিনই আসছে অবৈধভাবে স্বর্ণের চালান * বিমান-সিভিল অ্যাভিয়েশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীও চোরাচালানে সহায়তা করছে * স্বর্ণপাচার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হযরত শাহজালালসহ তিন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ
স্বর্ণ চোরাচালানের সিন্ডিকেট সক্রিয়
- আপলোড সময় : ১৩-০৬-২০২৫ ১২:৪১:৩৩ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৩-০৬-২০২৫ ১২:৪১:৩৩ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ