* গ্যাসের অভাবে দুদিন অনেক বাড়িতেই চুলা জ্বলেনি
* গ্যাস সংকটে বাসাবাড়িতে জ্বলছে না চুলা, শিল্প উৎপাদন ব্যাহত
* পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হতে শুরু করেছে: পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা
গত কয়েক মাস যাবত দেশজুড়ে এমনিতেই চলছে গ্যাসের তীব্র সংকট। এর মধ্যে সরবরাহ আরও কমে যায়। বৈরী আবহাওয়ার কারণে কক্সবাজারের মহেশখালীর গভীর সাগরে অবস্থিত টার্মিনাল থেকে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। মূলত আমদানি করা এলএনজি খালাসে বিঘ্ন ঘটায় টানা তিনদিন ধরে তীব্র গ্যাস সংকটে পড়েছে দেশের মানুষ। গত মঙ্গলবার থেকে এ সমস্যা শুরু হয়। এতে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দেয়। বিশেষ করে আজ দিনভর বাসাবাড়ি ও শিল্পে ভোগান্তি চরম আকার নেয়। তবে এদিন সন্ধ্যা থেকে এলএনজি সরবরাহ বাড়তে থাকায় পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। গত মঙ্গলবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কল কারখানার চাকা বন্ধ হয়েছে, সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো হঠাৎ গ্যাস দিতে পারছে না, বাসাবাড়িতেও রান্নাবান্না বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত দুই এলএনজি টার্মিনাল থেকে ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে। গত সোমবার দেয়া হয় প্রায় ১০০ কোটি ঘনফুট। সাগর উত্তাল থাকায় মঙ্গলবার থেকে টার্মিনালগুলোতে এলএনজি আমদানি করা কার্গো যুক্ত হতে পারছে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে টার্মিনালে মজুত এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন করে লাইনে গ্যাস দেয়া হচ্ছে। এতে মঙ্গলবার রাত থেকেই সরবরাহ কমতে শুরু করে। বুধবার সন্ধ্যায় সরবরাহ কমে ২০ কোটি ঘনফুটে নেমে আসে। বৃহস্পতিবারও দিনভর ২০-২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে এলএনজি টার্মিনালগুলো। দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক অন্তত ৪২০ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে এলএনজিসহ বর্তমানে দিনে গড় সরবরাহ ২৮১ কোটি ঘনফুট। এলএনজির সরবরাহ কমায় মোট গ্যাস সরবরাহ কমে দাঁড়ায় ২০০ কোটি ঘনফুট। ফলে দেশজুড়ে সংকট বিরাট আকার ধারণ করে। তবে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যে দুই টার্মিনালে দুটি কার্গো জাহাজ যুক্ত হয়েছে। এলএনজি সরবরাহ বেড়ে ৬০ কোটি ঘনফুট হয়েছে। সকাল নাগাদ তা ১০০ কোটিতে পৌঁছাবে বলে তিনি আশা করেন।
পেট্রোবাংলার অপারেশন অ্যান্ড মাইন বিভাগের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলছেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। শুক্রবার দুপুর নাগাদ অনেক এলাকায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে সব জায়গায় সরবরাহ স্বাভাবিক হতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় প্রয়োজন। সে কারণে একই সময়ে ঢাকার সব আবাসিক এলাকায় গ্যাস সংকট লাঘবের খবর মেলেনি।
রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় ভোজন বিলাস নামের একটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক আলমগীর হোসেন শুক্রবার দুপুরে বলেন, গত দুই দিন ধরে বনশ্রী এলাকায় গ্যাস নেই। এখনও নেই। আমার হোটেলের রান্না ঘরে লাইনের গ্যাস আর সামনে রুটি পরটা ভাজার জন্য এলপি গ্যাস। গত দুই দিন এলপি গ্যাসের চুলা দিয়েই যতটা সম্ভব রান্না করতে হচ্ছে। একই পরিস্থিতি বাসাবাড়িতেও। গ্যাস নেই, তাই রান্নাও নেই। যাদের বিকল্প চুলা আছে তারা কিছুটা পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারলেও বাকিরা পড়ছেন বিড়ম্বনায়। শান্তিনগরের বাসিন্দা সাদিয়া আক্তার বলেন, দীর্ঘদিন গ্যাসের সমস্যা ছিল না। ফলে ইলেক্ট্রিক চুলা কোথায় রেখেছি মনে ছিল না। একদিন গ্যাসের কষ্ট করার পর গতকাল চুলা খুঁজে বের করলাম। তিনি প্রশ্ন করেন, এটা তো বাড়তি ঝামেলা। গ্যাসের সমস্যা কেন হচ্ছে, পরিস্থিতি কী সহসা ঠিক হবে। খিলগাঁওয়ের একটি ছোট খাবার হোটেলের কর্মচারী শরীফ বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই দেখলাম হোটেলে কাস্টমারের ভিড় অন্যদিনের চেয়ে বেশি। পরে শুনলাম গ্যাস সংকটের কারণে অনেকের বাসাবাড়িতে রান্না হয়নি। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগরে ভাসমান গ্যাস টার্মিনালে এলএনজির জাহাজ ভেড়ানো যাচ্ছিল না। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হতে থাকে। ঢাকার গোপীবাগ এলাকার ঝর্ণা রায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন, তার বাসায় গ্যাস নেই। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারাও তাঁর স্ট্যাটাসে কমেন্ট করে জানান, তাদের এলাকাতেও গ্যাস নেই। চুলা জ্বলছে না। জানতে চাইলে সন্ধ্যায় ঝর্ণা বলেন, সকাল থেকে চুলায় গ্যাস ছিল না বললেই চলে। সন্ধ্যার দিকে একটু চাপ বেড়েছে, তাও চুলা জ্বলার মতো গ্যাস আসেনি। আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা রফিকুল জানান, বুধবার রাত থেকেই গ্যাসের চাপ কম ছিল। বৃহস্পতিবার সারাদিন চুলা জ্বলেনি। বাইরে থেকে খাবার এনে খেতে হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে গিয়েছিল এই কারণে। সমস্যা দেখা দেয়ার পর থেকেই দৈনিক গ্যাস প্রতিবেদন প্রকাশ করা বন্ধ রেখেছে পেট্রোবাংলা। তবে সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ ছিল ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি। সেই সরবরাহ দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে যায় গত কয়েক দিনে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সামিট এলএনজি এবং এক্সিলারেট এনার্জির এলএনজি টার্মিনাল দুটিতে কার্গো ভেড়ানো যায়নি। তবে বৃহস্পতিবার নাগাদ সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে পেট্রোবাংলার পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম দুপুরে বলেন, দুপুর ১২টার খবর হচ্ছে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। সেক্ষেত্রে জাতীয় সঞ্চালন ২৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের কাছকাছি। অর্থাৎ পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। ধীরে ধীরে গ্রাহক পর্যায়েও এর প্রভাব পড়বে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর জানান, গত বুধবার দেশের অধিকাংশ স্থান থেকে সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো গ্যাসশূন্য হয়ে যাওয়ার অভিযোগ আসছিল। এলএনজি টার্মিনালে সমস্যা হওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন।
গ্যাস সংকটে বাসাবাড়িতে জ্বলছে না চুলা, শিল্প উৎপাদন ব্যাহত : বঙ্গোপসাগর প্রবল উত্তাল থাকায় মহেশখালীর এলএনজিবাহী জাহাজ থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে চট্টগ্রামে আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ দিতে পারছে না কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। যার ফলে নগরীর অধিকাংশ এলাকার বাসাবাড়িতে জ্বলছে না চুলা। বুধবার সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার সকালে প্রথমে চট্টগ্রামে গ্যাসের চাপ মারাত্মকভাবে কমে যায়। আর গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় গ্যাস সরবরাহ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্পকারখানায়ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় রান্নাবান্না নিয়ে বিপাকে পড়েন নগরবাসী। গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ডিভিশন) মো. নজরুল ইসলাম গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। গ্যাস না পেয়ে নগরজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। এদিন সকালে চুলায় গ্যাস জ্বলতে না দেখে অনেকে হোটেল-রেস্তোরাঁয় ছুটে যান। কিন্তু বহু রেস্তোরাঁয়ও রান্না হয়নি। ফলে চাহিদার তুলনায় খাবার কম থাকায় অনেককেই ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। নগরীর বিভিন্ন খাবারের দোকানের সামনে গ্রাহকদের ভিড় দেখা গেছে। অনেক এলাকায় বৈদ্যুতিক চুলা ও লাকড়ি জ্বালিয়ে রান্নার কাজ সারেন বাসিন্দারা। নগরীর ফিলিং স্টেশনগুলোতেও যানবাহনের দীর্ঘ লাইন লেগে যায়। সেখানেও নেই গ্যাস। এ কারণে সড়কে কমে যায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চলাচল। কেজিডিসিএল কর্মকর্তারা জানান, এলএনজিবাহী বিশেষায়িত জাহাজ থেকে দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ হতো। সেখানে বুধবার সন্ধ্যায় ১৯৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হয়েছে। সকাল ৯টার পর গ্যাস সরবরাহ একেবারে বন্ধ রয়েছে। বৈরী আবহাওয়া স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হবে না। পূর্বনির্দেশনা ছাড়াই হঠাৎ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। বৃহস্পতিবার নগরীর চকবাজার, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, কাজির দেউড়ী, কাট্টলী, খুলশী, হালিশহর, চান্দগাঁও, মোহরা, বাকলিয়াসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এতে ওই এলাকার বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় নগরীর ইপিজেড, বায়েজিদ বোস্তামী শিল্প এলাকা, কালুরঘাট শিল্প এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় শিল্প উৎপাদনে মারাত্মকভাবে ব্যাঘাত ঘটেছে। কিছু কিছু এলাকায় বুধবার রাত থেকে শিল্পকারখানা ও সিএনজি স্টেশনেও গ্যাস ছিল না। এতে কারখানায় উৎপাদন ও সিএনজি স্টেশন থেকে গাড়িতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গ্যাস স্টেশনগুলোতে সকাল থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। গ্যাসের অভাবে নগরীতে টেম্পো, মিনিবাস, অটোরিকশা ও হিউম্যান হলার চলাচল বন্ধ ছিল। বিভিন্ন রুটে ছোট আকারের কিছু গণপরিবহণ চলাচল করতে দেখা যায়, যেগুলো আগের রাতে গ্যাস নিয়ে রেখেছিল। তবে এগুলোতে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হয় দ্বিগুণ ভাড়া।
বিটিএল অ্যাপারেলস লিমিটেডের পরিচালক আয়ুব আলী জানান, গ্যাস সংকটের কারণে তাদের কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাসনির্ভর কারখানাগুলোতে উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় বেশি সমস্যা হবে রপ্তানিমুখী শিল্পে। কারণ যথাসময়ে অর্ডার অনুযায়ী পণ্য শিপমেন্ট করতে না পারলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এতে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ে। জিটিসিএল মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ডিভিশন) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘খারাপ আবহওয়ার কারণে বিশেষায়িত জাহাজ থেকে গ্যাস নেয়া যাচ্ছে না। ফলে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সাগর স্বাভাবিক হলে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
