ঢাকা , সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫ , ২৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
লাল চাঁদ হত্যার বিচারে বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবি- মির্জা ফখরুল শ্যামলীতে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাই খুলে নিয়ে গেলো জামা-জুতাও অদৃশ্য শত্রু ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে- তারেক রহমান দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ডাকসুর প্যানেল নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর লুকোচুরি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হবে- স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জামায়াত আমিরের উদ্বেগ চোখে অশ্রু-কণ্ঠে একরাশ হতাশা সরকারের নানা পদক্ষেপেও বিদেশী বিনিয়োগে ধস কিটের অভাবে পরীক্ষা ছাড়া লক্ষণ দেখেই চলছে চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা সায়মা ওয়াজেদের ছুটি জবাবদিহিতার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ- প্রেস সচিব অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে সায়মা ওয়াজেদ, দাবি পলিসি ওয়াচের প্রতিবেদনে চারদিনের সফরে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব চাঁদাবাজি নয় ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে খুন হন লাল চাঁদ-পুলিশ খুনিদের পায়ে লুটিয়ে পড়েও বাঁচাতে পারেনি লাল চাঁদ উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় কুপিয়ে জখম করা খতিব, থানায় মামলা পুরান ঢাকার এই হত্যাকাণ্ড জাহিলিয়াতের যুগের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে-কাজী মামুনূর রশিদ মিটফোর্ডের ঘটনায় কিছু রাজনৈতিক দল ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে- রিজভী ফেনীর তিন নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কাজ এক নম্বর হতে হবে-ত্রাণ উপদেষ্টা
সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষ

চোখে অশ্রু-কণ্ঠে একরাশ হতাশা

  • আপলোড সময় : ১৩-০৭-২০২৫ ০৭:২৬:০৪ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৩-০৭-২০২৫ ০৭:২৬:০৪ অপরাহ্ন
চোখে অশ্রু-কণ্ঠে একরাশ হতাশা
* জুন মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে শতকরা ৮.৪৮ শতাংশ : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং


অস্থির দেশের নিত্যপণ্যের বাজার। প্রতিদিনই দাম বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের। এতে মিলছে না ভোক্তার আয়-ব্যয়ের হিসাব। তাদের দাবি, আয়ের চেয়ে বেড়ে গেছে ব্যয়। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মূলত এসব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশি আয় দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের চোখে অশ্রু আর কণ্ঠে একরাশ হতাশা দেখা গেছে।
জানা গেছে, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, আয় কমে যাওয়া সব মিলিয়ে রাজধানী ঢাকায় বেঁচে থাকাটা আজ এক কঠিন যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের। জীবন সংগ্রামের এমন করুণ চিত্র যেন প্রতিটি মুখেই। ঝালমুড়ি, বাদাম, ছোলা, মৌসুমি ফল কিংবা খেলনা সবকিছুরই বিক্রি কমেছে ব্যাপক হারে। মানুষ কিনতে পারছে না, ব্যবসায়ীরাও বেঁচে থাকার তাগিদে লড়ছে প্রতিদিন। একইসঙ্গে বাজারে এখন আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন সাধারণ ভোক্তারা। হিমশিম খেতে হচ্ছে সংসার চালাতে।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়ে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি বছরের গত জুন মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ০৫ শতাংশ। ২০২৪ সালে জুন মাসে ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এ তথ্য প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতির এ পতনের প্রধান কারণ খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামের হ্রাস। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি জুন মাসে নেমে এসেছে ৭.৩৯ শতাংশে, যা গত মাসে ছিল ৮.৫৯ শতাংশ। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিছুটা কমায় সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। অপরদিকে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৯.৩৭ শতাংশ হয়েছে-যা মে মাসে ছিল ৯.৪২ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট ভোক্তারা জানান, প্রতিদিনই বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। তার বিপরীতে কমছে না; কমলেও খুবই নগণ্য। কথা হয় আনিসুল নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে। তিনি বলেন, রাত পোহালেই বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। ভোক্তারা এখন ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতিতে মিলছে না সংসারের আয়-ব্যয়ের হিসাব। সঞ্চয় ভেঙে কোনোমতে সংসার চালাতে হচ্ছে। আরেক ভোক্তা অর্ণব সাহা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোটা যেন একধরনের ফ্যাশন হয়ে গেছে। কোনো একটা কিছু হলেই বেড়ে যায় পণ্যের দাম। উৎসব এলে কিংবা বৃষ্টি বা গরম হলেই দাম বাড়ানোর উৎসবে মেতে ওঠেন ব্যবসায়ীরা। এতে বিপাকে পড়েন নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা। শুধু নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তই নয়, মূল্যস্ফীতিতে নাকাল মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তরাও। আব্দুস সালাম নামে এক সরকারি চাকরিজীবী বলেন, বাজারে যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, এতে সংসার চালানোই দায়। ব্যয় করতে হচ্ছে হিসাব করে। অতি প্রয়োজনের বাইরে কোনো পণ্য কেনা মানে এখন বিলাসিতা। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিত্যপণ্যের এমন ঊর্ধ্বমুখী দামে লোকসানে তারাও। কমে গেছে বেচাবিক্রি। বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। সব জিনিসের দাম বাড়তি। দিন শেষে আমিও একজন ক্রেতা। সংসার চালাতে এখন আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলছে না।
গত দ্ইু মাস ধরে ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন আলামিন খান নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। চোখে অশ্রু, আর কণ্ঠে একরাশ হতাশা নিয়ে রাজধানীর রামপুরা ব্রিজের পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, এক বছর আগেও প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ২ হাজার টাকার বিক্রি করতাম। এখন সারাদিনে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা আয় করতেও হিমশিম খাচ্ছি। পরিবার নিয়ে ঢাকা শহরে টেকে থাকা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। আমার দুইটা ছোট্ট মেয়ে আছে। সারাদিন ঝালমুড়ি বিক্রির পর যখন ঘরে ফিরে তাদের ভালো-মন্দ খাবার দিতে পারি না,তখন নিজেকে খুবই অসহায় মনে হয়। ভাই মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মরে যাই। মৌসুমি ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বিল্লালের চিত্রটাও আলামিনের মতোই করুণ। গত ৯ বছর ধরে রামপুরা ব্রিজের পাশে ব্যবসা করছেন। আগে প্রতিদিন ৫-৬ হাজার টাকা বিক্রি হলেও এখন তা নেমে এসেছে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। গত কোরবানি ঈদের পরে দুদিন ভালো বিক্রি হলেও তারপর থেকে ধস নেমেছে। বিল্লাল বলেন, মানুষের হাতে এখন টাকা নাই। শুধু পণ্যের দাম না, আয়ও কমে গেছে।
ধানমন্ডির গ্রিন রোডে একটি ক্লিনিকের পাশে মার্কেটের সামনে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে জড়ো হন ২৫ থেকে ৩০ জন রংমিস্ত্রি। বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়িওয়ালারা এসে কাজের জন্য নিয়ে যান তাদের। তবে এখানে অপেক্ষায় থাকা সবার কাজ জোটে না প্রতিদিন। এই শ্রমিকদের একজন বরিশালের মনির হোসেন। থাকেন ঝিগাতলায় একটি ভাড়া বাড়িতে। মনির জানালেন, স্ট্রোক করে বাবা শয্যাশায়ী। স্ত্রীও অসুস্থ। এ ছাড়া আছেন মা, ভাই ও সন্তান। সংসারে অনেক খরচ। কিন্তু মাসে ২০ দিন কাজ থাকলে ১০ দিন থাকে না। দিনে মজুরি পান ৮০০ টাকা। নিয়মিত কাজ থাকলে এই টাকায় সংসার চালাতে কষ্ট হতো না। বাসা ভাড়া দিতে হয় ৮ হাজার টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম চড়া। ঘরে দুজন অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার খরচ চালাতে খুব কষ্ট হয়। সেইসঙ্গে আছে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ। গতকাল শনিবার সকালে গ্রিন রোডের আনন্দ রেস্টুরেন্টের পাশে কাজের অপেক্ষায় ছিলেন প্রায় ২৫ জন নির্মাণ শ্রমিক। ৯টা পর্যন্ত কাজ পেয়েছেন ১০ জন। হতাশ হয়ে বসে ছিলেন বাকিরা। তাদের একজন রাজশাহীর মাহমুদ। কাজের সন্ধানে ৩০ বছর আগে ঢাকায় এসেছেন তিনি। সেই থেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন। থাকেন গ্রিন রোডের সার্জেন্ট গলিতে। মাহমুদ নামে একজন বলেন, দুই ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে ছোট্ট সংসার। ছেলেরা স্কুলে পড়ে। বাসা ভাড়া ৬ হাজার টাকা। যেদিন কাজ পাই আট ঘণ্টা কাজ করলে কখনো ৮০০, কখনো ১ হাজার টাকা মজুরি পাই। মাসে ২০ দিনের মতো কাজ পাই। আবার কোনো মাসে এর চেয়েও কম। সব মিলিয়ে কষ্টের মধ্যে বেঁচে আছি।
গ্রিন কর্নারের গলিতে ভ্যানগাড়িতে আলু, পটোল, করলাসহ নানা রকম সবজি সাজিয়ে বিক্রি করছিলেন আলী নূর। তাকে সহযোগিতা করছেন স্ত্রী রওশন আরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫৫ বছর বয়সী আলী নূর একটি স্টিল কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছেন। এই দম্পতি জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুর। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আগেই। সবজি বিক্রি করে যা আয় হয় বাকি দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনো রকমে দিন চলে যাচ্ছে। টাকার অভাবে ছোট মেয়েকে কলেজে পড়াতে পারেননি তারা। গুলশান আর মহাখালীর দুটি ক্লিনিকে খণ্ডকালীন কাজ করেন আকলিমা। সব মিলিয়ে মাসে পান ৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে ঘর ভাড়ায়ই চলে যায় আড়াই হাজার টাকা। আকলিমা বলেন, সকাল-বিকেল দুই ক্লিনিকে কাজ করে যা পাই তাতে এই দুর্মূল্যের বাজারে ঢাকা শহরে চলা খুবই কষ্টকর।
ষাটোর্ধ্ব মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা মাথায় বড় একটি বোল ও হাতে একটি টুল নিয়ে তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া থেকে মহাখালী রেলস্টেশনের দিকে যাচ্ছিলেন। ছেলে-মেয়েসহ সাতজনের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মোস্তফা। গতকাল শনিবার দুপুরে আলাপচারিতার একপর্যায়ে তিনি বলেন, ছেলে ও পুত্রবধূ পাশের এক কারখানায় অল্প বেতনে চাকরি করেন। মোস্তফা জানান, বর্তমানে বেচাকেনা কম। বছরখানেক আগেও দৈনিক ১২০০-১৫০০ টাকা বিক্রি করতে পারতেন। বর্তমানে সেই বেচাকেনা কমে দাঁড়িয়েছে ৫০০-৮০০ টাকার মধ্যে। তিনি বলেন, গত বুধবার যে টাকার মাল নিয়ে গেছিলাম সেই পুঞ্জি (পুঁজি) ওডে নাই। ভাজাপুরি বিক্রেতা শাহিন বলেন, আগে বিকাল হলেই পুলিশ এসে ২৪০ টাকা চাঁদা নিত, এখন ডাবল দিতে হয়। আগের মতো বিক্রি হলে কোনো অসুবিধা ছিল না। যা বেচা-বিক্রি হয়, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, আর পারছি না। যাত্রাবাড়ীর পুলিশ বকসের পাশে বাজারে বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি করেন আবদুল আওয়াল নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। প্রতিদিন মাটিতে মাদুর বিছিয়ে মালামাল বিক্রি করেন। তিনি বলেন, মানুষের হাতে টাকা নাই, একমাস হইলো ঈদ গেছে। তারপরও ৫ টাকা, ১০ টাকার জিনিস নিয়েও দামাদামি করে। মাঝে মাঝে লোকসান করে জিনিস বিক্রি করতে হয়। এক প্রশ্নের জবাবে এই বিক্রেতা জানান, এখন মানুষের হাতে টাকা কম। পণ্যের দাম বাড়ছে, কিন্তু আয় বাড়ছে না। ফলে কম আয়ের মানুষ যেমন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে, তেমনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও আয় হারিয়ে জীবিকার টানে আরও হতাশ হয়ে পড়ছেন। এদের কারও কারও মতে, আগের মতো শহরের ফুটপাতে মানুষজনের ভিড় কম। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে কি না-এ আশঙ্কাও জেগে উঠছে তাদের মনে। মহাখালী কড়াইল বস্তির তিন নম্বর সরু গলির শেষ মাথার একটি ঘরে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন রিকশা শ্রমিক মামুন মিয়া। ভোরে পূর্ব আকাশে সূর্য উঁকি দেওয়ার পরপরই জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমেছিলেন। তীব্র গরমে প্রায় নয় ঘণ্টা রিকশা ঠেলে দুপুরে বিশ্রামের জন্য ঘরে ফিরেছেন। কিছুক্ষণ পর ঘামে একাকার হয়ে ফেরেন মামুনের স্ত্রী স্বপ্না। বস্তির ছোট্ট ঘরে বসেই এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন তারা। স্বপ্না জানান, স্বামীর একার আয়ে সংসার চলে না। তাই বনানীর দুটি বাসায় কাজ নিয়েছেন। সকাল ৭টার দিকে ঘর থেকে বের হতে হয়। কাজ শেষ করে ফেরেন দুপুরে। দুই বাসায় কাজ করে পান ৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে ঘর ভাড়ায় চলে যায় ৩ হাজার টাকা। দুই মেয়ে স্কুলে পড়ে। তাদের পড়াশোনার খরচও চালান স্বপ্না। রিকশাচালক মামুন বলেন, দুজনে সারাদিন খাটুনির পর যা রোজগার করি, তা দিয়ে সংসার চলে না। তার ওপর প্রচণ্ড রোদে একটানা রিকশা চালাতে পারি না। এ কারণে রোজগারও কমে গেছে। অন্যদিকে সব জিনিসের দাম বেশি। শাকসবজি, আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাবো এর উপায়ও নেই। আলুর কেজি ৬০ টাকা। একটা কচুর দাম ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। কচুশাক এখন বড়লোকের খাবার। শুধু স্বপ্না ও মামুন নন, দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষেরই এখন একই দশা। ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই চড়া। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত আয়ের ওপর নির্ভরশীল অধিকাংশ মানুষ কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ এম আবু ইউসুফ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য আসন্ন বাজেটে একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। আরেক অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, বর্তমানে বাজারে সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও বাড়ছে দাম, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বাড়তি চাপ হয়ে যাচ্ছে। তাদের আয়ের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রেই বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে ভাঙতে হচ্ছে সঞ্চয়। তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকার যখন অভিযান চালায় তখন কিছুদিন পণ্যের দাম কমলেও, অভিযান বন্ধ হলে পুনরায় আবার দাম বাড়ে। তবে দেশের নিম্নবিত্ত ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি বিদেশি ডলার পাচার প্রতিরোধে কার্যকর ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. এম এম আকাশ। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারিত করে দেয়ার জন্য আলাদা প্রাইস কমিশন গঠন করে সেখানে গণশুনানির মাধ্যমে নিত্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। যারা নির্ধারিত আয়ে চলে অর্থাৎ স্যালারি ক্লাস এবং যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছেন অর্থাৎ নিম্নবিত্ত; সব মিলিয়ে সমাজের নিচের অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা জালের আওতায় আনতে হবে। শহরগুলোতে ট্রাকসেলের মতো যেসব রেশনিং ব্যবস্থা আছে সেগুলোকে আরও বিস্তৃত করতে হবে। পাশাপাশি বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাব ভেঙে দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে সাধারণ ভোক্তাদের রক্ষা করতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারকে বাজারে এমন সিগন্যাল দিতে হবে যেন সবাই বুঝতে পারে সরকার এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তবে ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দেয়। আর যখন বেচাবিক্রি কমে যায় তখন ব্যবসায় লাভও কমে যায়। অন্যদিকে তার প্রতিদিনের খরচ কিন্তু কমে না। বিশেষ করে তাদের দৈনিক রাস্তায় চাঁদা, বিদ্যুৎ খরচ, দোকান ভাড়া, বাসাভাড়া, খাবার, পরিবহন, সন্তানদের শিক্ষা ইত্যাদির খরচ কমানো যায় না। অথচ লাভের পরিমাণ কমে। আর খরচ ঠিকই থেকে যায়। এর ফল দাঁড়ায় তাদের আয় কমে যাওয়া।
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স