ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জায় কাবু মানুষ

আপলোড সময় : ২৮-০৮-২০২৫ ০৫:৪১:৪৪ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ২৮-০৮-২০২৫ ০৫:৪১:৪৪ অপরাহ্ন
দুই দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন বেসরকারি চাকরিজীবী মনির। জ্বরের সঙ্গে রয়েছে শরীরে তীব্র ব্যথা। এমন জ্বরকে সাধারণত ‘মৌসুমি ফ্লু’ হিসেবে মনে করা হলেও এবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তিনি। কারণ, সম্প্রতি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে। ফলে সংক্রমণের দুশ্চিন্তায় দিন পার করছিলেন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানতে পারলেন তার চিকুনগুনিয়া হয়েছে। আর তাতে শরীরের অবস্থা ভয়ানক পর্যায়ে চলে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন জ্বর হলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মাঝে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে বাড়ছে ভাইরাসঘটিত নানা রোগ। টাইফয়েড, মৌসুমি ফ্লু কিংবা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ একে অপরের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই পরীক্ষায় ফলাফল নেগেটিভ এলেও উপসর্গ থেকেই যাচ্ছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, রোগীদের অর্ধেকই ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত। চলতি বছরের জুলাই মাসে ১৯টি হাসপাতালে তীব্র জ্বর, কাশি এবং শরীর ব্যথার মতো উপসর্গ নিয়ে আসা ১ হাজার ৮৪৭ জন রোগীর ওপর আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআর,বি ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিলেন্স পরিচালনা করেছে। তাতে দেখা গেছে, আক্রান্তদের প্রায় ৫৭ শতাংশ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত। অর্থাৎ প্রতি ১০ জনে প্রায় ৬ জন ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত। আইইডিসিআর জানায়, ২০২৩ সালে এই হার ছিল অনেক কম, ২৫ শতাংশ। ২০২৪ সালে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল জুন মাসে, ৩৭ শতাংশ। ২০০৭ সালের পর থেকে এটিই এক মাসে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শ্বাসযন্ত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মৌসুমি ফ্লু হয়, যা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। বেশির ভাগ রোগী চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণরা গুরুতরভাবে আক্রান্ত হতে পারেন। চিকিৎসকদের মতে, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুম। সে জন্য এই মৌসুমে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি, যেমন-মাস্ক পরা, মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দেওয়া, হাত ধোয়া ইত্যাদি মেনে চলতে হবে। প্রতিবছর ফ্লু মৌসুম শুরুর আগে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকা নেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের (৬৫ বছরের বেশি বয়সী, যারা হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং শ্বাসকষ্টের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, গর্ভবতী নারী, ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু) জন্য ফ্লু টিকা নেওয়া জরুরি। কোনও কারণে ফ্লু মৌসুম শুরুর আগে টিকা নিতে না পারলে মৌসুম শুরু হওয়ার পরেও টিকা নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাসে সর্দি-কাশি নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল ৪ হাজার ২৪ জন শিশু। জুলাই মাসে তা বেড়ে হয় ৬ হাজার ২৫৫ জন। ওই মাসে হাসপাতালের বহির্বিভাগে ৯ হাজার ৩৬৭ জন শিশু চিকিৎসা নেয়। তাদের মধ্যে ৬ হাজার ২৫৫ জন, অর্থাৎ ৬৬.৬৭ শতাংশই সর্দি-জ্বরে ভুগেছে। আগস্ট মাসের প্রথম ২০ দিনে এ হাসপাতালের বহির্বিভাগে ২ হাজার ২২৯ জন শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৯২১ জন, অর্থাৎ ৮৬ দশমিক ১৮ শতাংশ এসেছে সর্দি-জ্বর নিয়ে। আইইডিসিআর পরামর্শ দিয়েছে-ফ্লু’র মৌসুমে সাবান পানি অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে ঘন ঘন হাত পরিষ্কার করুন। কাশি শিষ্টাচার মেনে চলুন। হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু দিয়ে বা বাহুর ভাঁজে নাক-মুখ ঢেকে রাখুন, ব্যবহৃত টিস্যু সঙ্গে সঙ্গে ঢাকনাযুক্ত পাত্রে ফেলে দিন এবং সাবান পানি, অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে ফেলুন। আপনার যদি জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট থাকে— তবে সুস্থদের থেকে দূরে থাকুন। যথাসম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার করুন। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী, যারা দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগে ভুগছেন এবং অন্তঃসত্ত্বা নারী—এদের জন্য প্রতি বছর ফ্লু মৌসুম শুরুর আগে ইনফ্লুয়েঞ্জার (ফ্লু) ভাইরাসের টিকা নেওয়া দরকার। জনস্বাস্থ্য ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা এক ধরনের ভাইরাস। এই ভাইরাসজনিত জ্বর মৌসুমি জ্বরের মতো। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে জ্বর অনেক বেশি বা কম হতে পারে। শরীরে ব্যথা থাকে। তীব্র মাথা ব্যথা থাকে, কাশি থাকতে পারে। এছাড়া খুব দুর্বল লাগতে পারে। সর্দি হতেও পারে, না-ও হতে পারে। এই জ্বর অনেকটা করোনা বা ডেঙ্গুর লক্ষণের মতো। কখনও কখনও শরীরে র‌্যাশও হয়। কিন্তু রক্তক্ষরণ হয় না। তিনি বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জার নির্দিষ্ট কোনও ওষুধ নেই। জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে হবে। ডেঙ্গু করোনার মতো এই ভাইরাস প্রাণঘাতী নয়। ডেঙ্গু পরিস্থিতিও বেশ অবনতির দিকে আছে। তবে চিকুনগুনিয়ার পরিসংখ্যান সেভাবে কারও জানা নেই। গত জুন মাসের ২১ তারিখ পর্যন্ত আইসিডিডিআর,বি’র ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরিজের বিভিন্ন শাখায় জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে মানুষ এসেছে। তাদের মধ্যে ১৭১ জন রোগীর আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করা হয়। সেখানে ১৪০ জনের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়, যা শনাক্তের হিসাবে প্রায় ৮২ শতাংশ। এই হার গত বছরের তুলনায় উদ্বেগজনক বলে মনে করে আইসিডিডিআর,বি। চলতি বছর ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্তের জেলা হচ্ছে বরিশাল। এ জেলায় এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬২৯ জনে। এরপরেই আক্রান্তের দিক দিয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী রয়েছে চট্টগ্রামে। বিভাগীয় শহরটিতে জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ২৭৯ জন। এ সময় রাজধানী ঢাকার আশপাশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৫৯ জনে। আর ঢাকার দুই সিটি অর্থাৎ ঢাকা উত্তর সিটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৬৪৬ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার ২০৮ জন। এরপরেই আক্রান্তের দিক থেকে সর্বোচ্চ রোগী রয়েছে রাজশাহীতে। উত্তরবঙ্গের এই বিভাগে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ১৬৮ জন। রংপুরে ১৯২ জন, ময়মনসিংহে ৪৯৫ জন এবং সিলেটে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৯ জন। মাস হিসেবে আক্রান্তের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল ১ হাজার ১৬১ জন। তবে ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিলে তুলনামূলক কম ৩৭৪ জন, ৩৩৬ জন এবং ৭০১ জন আক্রান্ত হন। মে মাসে আবারও আক্রান্তের সংখ্যা হাজারের ঘর ছাড়ায়। ওই মাসে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৭৩ জন। জুন মাসে আক্রান্ত হয় ৫ হাজার ৯৫১ জন। জুলাইয়ে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ৬৮৪ জন। আর ২৬ আগস্ট পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৩৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে’তে ১ হাজার ৭৭৩ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫১ জন এবং জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ৭ জন, মে’তে ৩ জন, জুনে ১৯ জন, জুলাইয়ে ৪১ জন এবং আগস্টে এখন পর্যন্ত ৩৫ মারা গেছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ডেঙ্গু পরিস্থিতির পূর্বাভাস-প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্টে টানা বৃষ্টি হওয়ায় ও বিগত বছরের অভিজ্ঞতা অনুসারে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এতে হাসপাতালগুলোতে ভর্তির চাপও বাড়তে পারে। তবে অক্টোবরে বর্ষা শেষে সংক্রমণ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও দ্বিতীয় দফায় প্রাদুর্ভাব চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এ সময়ও লার্ভিসাইডিং ও স্যানিটেশন কার্যক্রম জোরদার রাখার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ম্যালেরিয়ার মতো পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্মিলিতভাবে সব সংস্থাকে একটি ইউনিটের মাধ্যমে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘কোনও একটা সংস্থা বা হাসপাতালের পক্ষে একা রোগী নিয়ন্ত্রণ বা মশা নিধন করা সম্ভব নয়। প্রতি বছরই তো একইভাবে চলছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট করা উচিত আইডিসিআরের মতো, যারা সমন্বয় করে কাজ করবে।’ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাসার বলেন, কয়েকদিন পরে যখন বৃষ্টিপাত কমে যাবে, তখন ডেঙ্গু রোগী ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করবে। কারণ, তখন এডিস মশার ঘনত্বটা বাড়তে শুরু করবে। ডেঙ্গুর পিক মৌসুম এখনও আসেনি। সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে না পারলে আগামী দুই মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : সৈয়দ এম. আলতাফ হোসাইন।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক : সৈয়দ মোঃ আতিকুল হাসান।

নির্বাহী সম্পাদক আশীষ কুমার সেন।

ফোন : ৪৯৩৫৭৭৩০ (বার্তা), ৮৩১৫৬৪৯ (বাণিজ্যিক), ফ্যাক্স; ৮৮-০২-৮৩১৪১৭৪

অফিস :

প্রকাশক কর্তৃক রোমাক্স লিমিটেড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে মুদ্রিত।

সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : খলিল ম্যানশন (৩য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা), ১৪৯/এ, ডিআইটি এক্সটেনশন এভিনিউ, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত।

ই-মেইল : [email protected], ওয়েবসাইট : www.dainikjanata.net