
দীর্ঘ ৬ বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বাধীন প্যানেলের বিজয় শুধু ক্যাম্পাসেই নয়, জাতীয় পর্যায়ে নতুন বিশ্লেষণের জন্ম দিয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ডাকসু নির্বাচনের ফল সবসময়ই বৃহত্তর রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্বাচনের ফলাফল একদিকে আনন্দ-উৎসবের জন্ম দিচ্ছে, অপরদিকে রাজনীতিতে নতুন সমীকরণে অশনি সংকেত হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের প্রত্যাশায় যখন পুরো দেশ, ঠিক তখনই রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন এক ঝড়ের সৃষ্টি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ফলাফল। প্রায় ছয় বছর পর, গত ৯ সেপ্টেম্বর সম্পূর্ণ নতুন এক রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের ফল শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং জাতীয় রাজনীতির গতিপথেও এক গভীর ও সুদূরপ্রসারী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর অভাবনীয় বিজয় এবং বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের শোচনীয় পরাজয় আগামী দিনের রাজনীতির জন্য কী বার্তা দিচ্ছে, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। যদিও ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন ঘিরে শিক্ষাঙ্গন ও জাতীয় রাজনীতিতে বিরাট আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজয় মানে কি জাতীয় রাজনীতিতে নৈতিকতানির্ভর ধর্মভিত্তিক শক্তির পুনরুত্থান? এ ঘটনার প্রভাব আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কতটা পড়তে পারে? এসব প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন কোনো জাতীয় নির্বাচনের মাপকাঠি না হলেও এটি নিঃসন্দেহে দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যারোমিটার। এই ফলাফল প্রমাণ করে যে, গণ-অভ্যুত্থানের পর তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। তারা প্রচলিত বড় দলগুলোর ওপর আস্থা হারাচ্ছে এবং বিকল্প খুঁজছে। ছাত্রশিবিরের এই বিজয় কেবল তাদের সাংগঠনিক শক্তির পরিচায়ক নয়, বরং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা এবং তরুণদের সাথে তাদের সংযোগহীনতারও প্রমাণ। জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য প্রগতিশীল দলগুলো যদি এই বার্তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়, তবে ডাকসুর এই ‘অশনি সংকেত’ জাতীয় রাজনীতিতেও বাস্তব রূপ নিতে পারে, যা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমীকরণকে পুরোপুরি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
জানা গেছে, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলকে শুধু চমক বললে কম বলা হবে। এটি ছিল এককথায় রাজনৈতিক ভূমিকম্প। কেন্দ্রীয় সংসদের ২৮টি পদের মধ্যে সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদসহ মোট ২৩টি পদেই জয়লাভ করেছে শিবির-সমর্থিত প্যানেল। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতীতে ডাকসুতে ছাত্রশিবির কখনো প্রকাশ্যে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দেওয়ার সাহস বা সুযোগ পায়নি, কেন্দ্রীয় পদে জয়লাভ তো দূরের কথা। সেই শিবির যখন এমন ভূমিধস বিজয় অর্জন করে, তখন তা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এক বড়সড় ধাক্কা হিসেবেই প্রতিভাত হয়। অপরদিকে, গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার অন্যতম দাবিদার হিসেবে বিবেচিত বিএনপির জন্য এই ফলাফল ছিল এক চরম বিব্রতকর বাস্তবতা। তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল একটি পদেও জয়লাভ করতে পারেনি। এই ভরাডুবি দলটির তৃণমূল পর্যায়ের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং তরুণ প্রজন্মের সাথে তাদের দূরত্বের বিষয়টিকেই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ডাকসুতে শিবিরের এই ঐতিহাসিক বিজয় আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়, বরং এর পেছনে ছিল দীর্ঘমেয়াদী, সুশৃঙ্খল ও কৌশলগত পরিকল্পনা। যেখানে ছাত্রদলের মতো সংগঠনগুলো তফসিল ঘোষণার আগেও ভিপি-জিএস প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারেনি, সেখানে ছাত্রশিবির প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম শিক্ষার্থীদের মাঝে পরিচিত করে তোলে। তাদের নির্বাচনী কৌশল ছিল বহুমাত্রিক।
১.তারমধ্যে অন্যতম ছিল-অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল ২. হলের রাজনীতিতে কৌশলগত অবস্থান ৩. ট্যাগিং রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা। প্রথমত, নিজেদের রক্ষণশীল ছাত্রসংগঠনের পরিচিতি থেকে বেরিয়ে আসতে তারা প্যানেলকে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ করার চেষ্টা করে। প্যানেলে চারজন ছাত্রী এবং চাকমা সম্প্রদায়ের একজন শিক্ষার্থীকে স্থান দিয়ে তারা একটি সর্বজনীন বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করে। সংবাদ সম্মেলনে হিজাব পরিহিত এবং হিজাববিহীন উভয় ধরনের নারী প্রার্থীদের উপস্থিতি তাদের কৌশলগত বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। দ্বিতীয়ত, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সোচ্চার, তখনও শিবির কৌশলগতভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তারা সরাসরি রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার না করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রয়োজন ও কার্যক্রমে যুক্ত থেকে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, যা নির্বাচনের মাঠে তাদের জন্য উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তৃতীয়ত্ব, অতীতে শিবিরকে কোণঠাসা করার জন্য যে ‘ট্যাগিং’ বা নেতিবাচক প্রচারণার রাজনীতি প্রচলিত ছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ যে তা পছন্দ করে না, এই বাস্তবতাটি তারা কাজে লাগিয়েছে। হল ও ক্যাম্পাসকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার পক্ষে তাদের জোরালো প্রচারণা শিক্ষার্থীদের সমর্থন আদায়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বড় দলগুলোর জন্য অশনি সংকেত ও সতর্কবার্তা : রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ুম ডাকসুর ফলাফলকে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের ‘হতাশা ও ক্ষোভের প্রকাশ’ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, এখান থেকে রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলে, জনগণের এই ক্ষোভকে বিবেচনায় না নিলে, জাতীয় রাজনীতিতেও বড় দলগুলোর জন্য এমন ভরাডুবির আশঙ্কা রয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী বিএনপির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই শিক্ষার্থীরা হয়তো পরীক্ষামূলকভাবে একটি নতুন, সুসংগঠিত শক্তিকে বেছে নিয়েছে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তবে তা জাতীয় রাজনীতিতে ডানপন্থার উত্থানকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে। যদিও জামায়াতে ইসলামী এই ফলাফলকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখছে। এ বিষয়ে কথা হয় ঢাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান এর সঙ্গে। তিনি বলেন, যে-যায়ই বলুক না কেন এই ফলের একটি বড় প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামী জাতীয় রাজনীতিতে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে চলে গেছে এবং নির্বাচনী প্রচারে তারা অনেকটাই এগিয়ে গেল। অন্যদিকে, বিএনপি যে সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল, তা জাতির সামনে উন্মোচিত হয়ে গেল। তবে অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান এর সঙ্গে একমত নন বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনীতিক দলের নেতারা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ডাকসুর নেতৃত্ব জাতীয় রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না, যদি না তারা কোনো বৃহৎ রাজনৈতিক দলের অংশ হয়। তার মতে, অতীতেও ডাকসুর অনেক নেতাই জাতীয় রাজনীতিতে হারিয়ে গেছেন। একইভাবে, নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষারও মনে করেন, এই ফল জাতীয় নির্বাচনে সরাসরি প্রভাব ফেলবে না, তবে বিজয়ীদের সাংগঠনিক মনোবল নিঃসন্দেহে চাঙা হবে। তবে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের বিশ্লেষণ আরও গভীর। তিনি এই ফলাফলকে জাতীয় নির্বাচনের প্রতিচ্ছবি মনে না করলেও এর পেছনের কারণ হিসেবে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের তৈরি করা রাজনৈতিক জমিনকে দায়ী করেছেন। তার মতে, তরুণ প্রজন্মের মনস্তাত্ত্বিক জগতে বড় পরিবর্তন এসেছে। তাদের আকাক্সক্ষার সাথে বিএনপি-সহ প্রগতিশীল দলগুলোর যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা উপলব্ধি করা জরুরি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটেছে। শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছে যে তারা সহিংসতা, সন্ত্রাস ও পেশিশক্তির পরিবর্তে সৎ, চরিত্রবান ও ছাত্রবান্ধব নেতৃত্ব চায়। জামায়াত আশা করছে, জাতীয় নির্বাচনেও এই সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন কোনো জাতীয় নির্বাচনের মাপকাঠি না হলেও এটি নিঃসন্দেহে দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যারোমিটার। এই ফলাফল প্রমাণ করে যে, গণ-অভ্যুত্থানের পর তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। তারা প্রচলিত বড় দলগুলোর ওপর আস্থা হারাচ্ছে এবং বিকল্প খুঁজছে। ছাত্রশিবিরের এই বিজয় কেবল তাদের সাংগঠনিক শক্তির পরিচায়ক নয়, বরং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা এবং তরুণদের সাথে তাদের সংযোগহীনতারও প্রমাণ। জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য প্রগতিশীল দলগুলো যদি এই বার্তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়, তবে ডাকসুর এই ‘অশনি সংকেত’ জাতীয় রাজনীতিতেও বাস্তব রূপ নিতে পারে, যা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমীকরণকে পুরোপুরি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
জানা গেছে, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলকে শুধু চমক বললে কম বলা হবে। এটি ছিল এককথায় রাজনৈতিক ভূমিকম্প। কেন্দ্রীয় সংসদের ২৮টি পদের মধ্যে সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদসহ মোট ২৩টি পদেই জয়লাভ করেছে শিবির-সমর্থিত প্যানেল। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতীতে ডাকসুতে ছাত্রশিবির কখনো প্রকাশ্যে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দেওয়ার সাহস বা সুযোগ পায়নি, কেন্দ্রীয় পদে জয়লাভ তো দূরের কথা। সেই শিবির যখন এমন ভূমিধস বিজয় অর্জন করে, তখন তা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এক বড়সড় ধাক্কা হিসেবেই প্রতিভাত হয়। অপরদিকে, গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার অন্যতম দাবিদার হিসেবে বিবেচিত বিএনপির জন্য এই ফলাফল ছিল এক চরম বিব্রতকর বাস্তবতা। তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল একটি পদেও জয়লাভ করতে পারেনি। এই ভরাডুবি দলটির তৃণমূল পর্যায়ের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং তরুণ প্রজন্মের সাথে তাদের দূরত্বের বিষয়টিকেই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ডাকসুতে শিবিরের এই ঐতিহাসিক বিজয় আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়, বরং এর পেছনে ছিল দীর্ঘমেয়াদী, সুশৃঙ্খল ও কৌশলগত পরিকল্পনা। যেখানে ছাত্রদলের মতো সংগঠনগুলো তফসিল ঘোষণার আগেও ভিপি-জিএস প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারেনি, সেখানে ছাত্রশিবির প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম শিক্ষার্থীদের মাঝে পরিচিত করে তোলে। তাদের নির্বাচনী কৌশল ছিল বহুমাত্রিক।
১.তারমধ্যে অন্যতম ছিল-অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল ২. হলের রাজনীতিতে কৌশলগত অবস্থান ৩. ট্যাগিং রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা। প্রথমত, নিজেদের রক্ষণশীল ছাত্রসংগঠনের পরিচিতি থেকে বেরিয়ে আসতে তারা প্যানেলকে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ করার চেষ্টা করে। প্যানেলে চারজন ছাত্রী এবং চাকমা সম্প্রদায়ের একজন শিক্ষার্থীকে স্থান দিয়ে তারা একটি সর্বজনীন বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করে। সংবাদ সম্মেলনে হিজাব পরিহিত এবং হিজাববিহীন উভয় ধরনের নারী প্রার্থীদের উপস্থিতি তাদের কৌশলগত বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। দ্বিতীয়ত, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সোচ্চার, তখনও শিবির কৌশলগতভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তারা সরাসরি রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার না করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রয়োজন ও কার্যক্রমে যুক্ত থেকে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, যা নির্বাচনের মাঠে তাদের জন্য উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তৃতীয়ত্ব, অতীতে শিবিরকে কোণঠাসা করার জন্য যে ‘ট্যাগিং’ বা নেতিবাচক প্রচারণার রাজনীতি প্রচলিত ছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ যে তা পছন্দ করে না, এই বাস্তবতাটি তারা কাজে লাগিয়েছে। হল ও ক্যাম্পাসকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার পক্ষে তাদের জোরালো প্রচারণা শিক্ষার্থীদের সমর্থন আদায়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বড় দলগুলোর জন্য অশনি সংকেত ও সতর্কবার্তা : রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ুম ডাকসুর ফলাফলকে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের ‘হতাশা ও ক্ষোভের প্রকাশ’ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, এখান থেকে রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলে, জনগণের এই ক্ষোভকে বিবেচনায় না নিলে, জাতীয় রাজনীতিতেও বড় দলগুলোর জন্য এমন ভরাডুবির আশঙ্কা রয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী বিএনপির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই শিক্ষার্থীরা হয়তো পরীক্ষামূলকভাবে একটি নতুন, সুসংগঠিত শক্তিকে বেছে নিয়েছে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তবে তা জাতীয় রাজনীতিতে ডানপন্থার উত্থানকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে। যদিও জামায়াতে ইসলামী এই ফলাফলকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখছে। এ বিষয়ে কথা হয় ঢাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান এর সঙ্গে। তিনি বলেন, যে-যায়ই বলুক না কেন এই ফলের একটি বড় প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামী জাতীয় রাজনীতিতে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে চলে গেছে এবং নির্বাচনী প্রচারে তারা অনেকটাই এগিয়ে গেল। অন্যদিকে, বিএনপি যে সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল, তা জাতির সামনে উন্মোচিত হয়ে গেল। তবে অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান এর সঙ্গে একমত নন বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনীতিক দলের নেতারা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ডাকসুর নেতৃত্ব জাতীয় রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না, যদি না তারা কোনো বৃহৎ রাজনৈতিক দলের অংশ হয়। তার মতে, অতীতেও ডাকসুর অনেক নেতাই জাতীয় রাজনীতিতে হারিয়ে গেছেন। একইভাবে, নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষারও মনে করেন, এই ফল জাতীয় নির্বাচনে সরাসরি প্রভাব ফেলবে না, তবে বিজয়ীদের সাংগঠনিক মনোবল নিঃসন্দেহে চাঙা হবে। তবে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের বিশ্লেষণ আরও গভীর। তিনি এই ফলাফলকে জাতীয় নির্বাচনের প্রতিচ্ছবি মনে না করলেও এর পেছনের কারণ হিসেবে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের তৈরি করা রাজনৈতিক জমিনকে দায়ী করেছেন। তার মতে, তরুণ প্রজন্মের মনস্তাত্ত্বিক জগতে বড় পরিবর্তন এসেছে। তাদের আকাক্সক্ষার সাথে বিএনপি-সহ প্রগতিশীল দলগুলোর যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা উপলব্ধি করা জরুরি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটেছে। শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছে যে তারা সহিংসতা, সন্ত্রাস ও পেশিশক্তির পরিবর্তে সৎ, চরিত্রবান ও ছাত্রবান্ধব নেতৃত্ব চায়। জামায়াত আশা করছে, জাতীয় নির্বাচনেও এই সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটবে।