
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও দেশের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ১৫ জেলা বন্যায় কবলিত হয়েছে। ১৫ জেলায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ বন্যায় তিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে রংপুর ও সিরাজগঞ্জে নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা কবলিত মানুষের মাঝে নগদ তিন কোটি ১০ লাখ টাকা, ৮ হাজার ৭০০ টন ত্রাণের চাল, ৫৮ হাজার ৫০০ বস্তা শুকনো খাবারের ব্যাগ ও অন্যান্য খাবার, শিশুখাদ্য কেনার জন্য ৬০ লাখ টাকা এবং গো-খাদ্য কেনার জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৬ হাজার ২২৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে গত কয়েক দিন ধরে রংপুর অঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ১২ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া, চিলমারী ও গাইবান্ধার ঘাঘট নদীর পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে নদ-নদী তীরবর্তী গ্রামের মানুষেরা চরম কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) রংপুরের উপ-সহকারী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শনিবার সকাল ৬টায় কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ২৬ দশমিক ৭৩ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ২৬ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার) বিপদসীমার দশমিক ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই দিন সকাল ৬টায় ব্রহ্মপুত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ২৩ দশমিক ৯৮ সেন্টিমিটার। যা বিপদসীমার দশমিক ৭৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পয়েন্টে বিপদসীমা ২৩ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার ধরা হয়। এছাড়া ঘাঘট নদীর গাইবান্ধা পয়েন্টে সকাল ৬টায় বিপদসীমার দশমিক ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
পাউবোর সূত্র বলছে, গতকাল শনিবার সকাল ৬টায় রংপুরের যমুনেশ্বরী নদীর বদরগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ২ দশমিক ৪৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। একই সময়ে ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম পয়েন্টে বিপদসীমার দশমিক ৪ সেন্টিমিটার নিচ, রংপুরে ঘাঘটের জাফরগঞ্জ পয়েন্টে ২ দশমিক ৬৭ সেন্টিমিটার নিচ, ইসলামপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১ দশমিক ৫৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
অপরদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। পানির চাপ মোকাবিলায় ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে রেখেছে কর্তৃপ। অব্যাহত বৃষ্টিপাত আর শুষ্ক মৌসুমে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের প্রভাব পড়েছে সাম্প্রতিক বন্যায়। নদীর পাড় ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে এবার লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা শহর রায় তৈরি করা চন্ডিমারী বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। এতে তিস্তা নদীর গতিপথ উল্টো দিকে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
গতকার শনিবার সকাল ৯টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার) বিপদসীমার দশমিক ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৬টায় বিপদসীমার দশমিক ১৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানির প্রবাহ রের্কড করা হয়। অর্থাৎ তিন ঘণ্টায় পানি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এদিন সকাল ৯টায় তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ২৮ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার) বিপদসীমার দশমিক ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৬টায় বিপদসীমার দশমিক ৪১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এদিকে প্রতিদিনের বৃষ্টিপাত আর উজানের ঢলে পানি বৃদ্ধির ফলে রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার সব নদ-নদীর পানি পাশাপাশি বিলের পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। একই সঙ্গে ফসলি জমিতে পানি ওঠায় নষ্ট হচ্ছে কৃষকের শাকসবজি, বীজতলা ও রোপা আমন ধানসহ বিভিন্ন ফসল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা উদ দৌলা বলেন, উজানের ঢলে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করেছে। পানির চাপ সামলাতে ৪৪টি গেট খুলে রাখা হয়েছে। টানা বৃষ্টির কারণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। এদিকে ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্য নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নদী খনন, সংরণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে গতকাল শনিবার দুপুরে তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে সমাবেশ করেন বলেও জানান তিনি।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আবহাওয়াবিদ মো. মোস্তাফিজার রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর জেলায় ১৩২ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। রংপুর বিভাগসহ দেশের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে রংপুরের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব রহমান বলেন, ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। রংপুর অঞ্চলের নদ-নদীতে পানি বাড়া-কমায় কিছু স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দ্রুত ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কুড়িগ্রামে দুর্ভোগে দিন কাটছে পাঁচ উপজেলার বানভাসি প্রায় দেড় লাধিক মানুষের। বন্যা-কবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনো খবার সংকট। চারণ ভূমি তলিয়ে থাকায় গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বন্যাদুর্গতরা। গতকাল শনিবার সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার ও হাতিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রায় ৪০ কিলোমিটার দৈর্ঘের ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার চর, দ্বীপচরসহ নিম্নাঞ্চল। চরাঞ্চলের অনেক বাসিন্দা ঘর-বাড়ি ছেড়ে উঁচু এলাকায় ও আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করলেও অনেকেই রয়েছে ঘর-বাড়িতে। নিম্নাঞ্চলের কাচা-পাকা সড়ক তলিয়ে থাকায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। পানিতে তলিয়ে থাকায় বন্ধ রয়েছে চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলের শতাধিক প্রাথমিক ও মাধ্যামিক বিদ্যালয়। সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঝুনকার চরের খোদেজা বেগম বলেন, গত পাঁচ-ছয় দিন যাবৎ ঘরে পানি। বাড়িতে থাকার মতো অবস্থা না থাকার কারণে পাশের উঁচু একটি স্থানে ছেলেমেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিছি। স্বামী বাড়িতে নেই, কাজ করতে ঢাকা গেছেন। খাওয়া দাওয়ার খুব কষ্ট আমার।
সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, আমার ইউনিয়নটি ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদবেষ্টিত। ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষ পানিবন্দি। সরকারিভাবে অল্প কিছু ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি যদি বেসরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয় তাহলে অনেক মানুষ কষ্ট থেকে রেহাই পেতো। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার বলেন, বন্যাকবলিত জন্য ২৯১ টন চাল, ২০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও সাড়ে ১৫ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা বিতরণ চলছে। গত কয়েক দিন ধরে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ১২ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জের দুটি পয়েন্টে যমুনার পানি ৯ ও ৪ সেন্টিমিটার বেড়ে সিরাজগঞ্জ শহর ও কাজিপুর উভয় পয়েন্টেই বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া যমুনায় পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার সব নদ-নদীর পানি পাশাপাশি বিলের পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে। এতে প্রতিদিনই নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে বসত-বাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলি জমিতে পানি ওঠায় নষ্ট হচ্ছে কৃষকের শাকসবজি, বীজতলা ও রোপা আমন ধানসহ বিভিন্ন ফসল। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের অনেকেই। পাশাপাশি জেলার কয়েকটি অংশে যমুনার পাড়ে হয়েছে তীব্র ভাঙন।
গতকাল সকালে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জিত কুমার সরকার বলেন, সকাল ৬টায় সিরাজগঞ্জ শহর রা বাঁধ হার্ড পয়েন্টে যমুনা নদীর পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৪৮ মিটার। গত ১২ ঘণ্টায় ৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপদসীমা ১২ দশমিক ৯০ মিটার)। অপরদিকে, কাজিপুরের মেঘাই ঘাট পয়েন্টে পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৫ দশমিক ৩৮ মিটার। এই পয়েন্টে গত ১২ ঘণ্টায় ৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপদসীমা ১৪.৮০ মিটার)।
রঞ্জিত কুমার সরকার বলেন, পানি বাড়লেও এই মুহূর্তে ভারী বন্যার আশঙ্কা নেই। আগামী ৮ জুলাই পর্যন্ত যমুনার পানি বাড়তে পারে। এ সময়ে পানি বেড়ে বিপদসীমার ৮০ সে.মি ওপর পর্যন্ত যেতে পারে। তবে পরবর্তীতে তিন-চার দিনের মধ্যে পানি নেমে যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন রোধে পাঁচ হাজার জিও ব্যাগের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যদিও আগে থেকেই জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান বলেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, রংপুর, জামালপুর, গাইবান্ধা, ফেনী, রাঙ্গামাটি, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট ও কক্সবাজার জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। বন্যা কবলিত ১৫ জেলায় এ পর্যন্ত নগদ তিন কোটি ১০ লাখ টাকা, ৮ হাজার ৭০০ টন ত্রাণের চাল, ৫৮ হাজার ৫০০ বস্তা শুকনো খাবারের ব্যাগ ও অন্যান্য খাবার, শিশুখাদ্য কেনার জন্য ৬০ লাখ টাকা এবং গো-খাদ্য কেনার জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনই বন্যা বিস্তৃতি লাভ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। পুরো ১৫ জেলায় মানুষ পানিবন্দি নয়। কোনো কোনো জেলা আংশিকভাবে বন্যা কবলিত। এখন পর্যন্ত আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৬ হাজার ২২৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বন্যায় এখন পর্যন্ত তিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। কেউ মারা যায়নি। এর মধ্যেই পানিবন্দি মানুষ রয়েছে। প্রতিদিনই মানুষ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। বন্যা-আক্রান্ত অঞ্চল নিয়ে সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বন্যা ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃতি লাভ করলে সেই জায়গাগুলোকেও আমরা অ্যাড্রেস করব। বন্যার কারণে দণি দিকেও প্লাবিত হতে পারে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামী মাস (আগস্ট) কিংবা তার পরের মাসেও (সেপ্টেম্বর) এ রকম আরেকটি বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী বন্যার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। সবার সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা কাজ করছি। তারপরও বিভিন্ন সময় পত্রিকায় দেখি যে, কোনো কোনো জায়গায় খাদ্য পায়নি। এ জন্য আমরা জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব। ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্য, ডিসি, ইউএনও যখন যেটা চাচ্ছেন আমরা দিচ্ছি। তারপরও গ্যাপ থাকার কোনো কারণ নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মনে করি বন্যাদুর্গত এলাকায় যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত।
পাউবোর সূত্র বলছে, গতকাল শনিবার সকাল ৬টায় রংপুরের যমুনেশ্বরী নদীর বদরগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ২ দশমিক ৪৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। একই সময়ে ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম পয়েন্টে বিপদসীমার দশমিক ৪ সেন্টিমিটার নিচ, রংপুরে ঘাঘটের জাফরগঞ্জ পয়েন্টে ২ দশমিক ৬৭ সেন্টিমিটার নিচ, ইসলামপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১ দশমিক ৫৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
অপরদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। পানির চাপ মোকাবিলায় ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে রেখেছে কর্তৃপ। অব্যাহত বৃষ্টিপাত আর শুষ্ক মৌসুমে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের প্রভাব পড়েছে সাম্প্রতিক বন্যায়। নদীর পাড় ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে এবার লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা শহর রায় তৈরি করা চন্ডিমারী বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। এতে তিস্তা নদীর গতিপথ উল্টো দিকে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
গতকার শনিবার সকাল ৯টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার) বিপদসীমার দশমিক ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৬টায় বিপদসীমার দশমিক ১৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানির প্রবাহ রের্কড করা হয়। অর্থাৎ তিন ঘণ্টায় পানি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এদিন সকাল ৯টায় তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ২৮ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার) বিপদসীমার দশমিক ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৬টায় বিপদসীমার দশমিক ৪১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এদিকে প্রতিদিনের বৃষ্টিপাত আর উজানের ঢলে পানি বৃদ্ধির ফলে রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার সব নদ-নদীর পানি পাশাপাশি বিলের পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। একই সঙ্গে ফসলি জমিতে পানি ওঠায় নষ্ট হচ্ছে কৃষকের শাকসবজি, বীজতলা ও রোপা আমন ধানসহ বিভিন্ন ফসল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা উদ দৌলা বলেন, উজানের ঢলে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করেছে। পানির চাপ সামলাতে ৪৪টি গেট খুলে রাখা হয়েছে। টানা বৃষ্টির কারণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। এদিকে ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্য নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নদী খনন, সংরণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে গতকাল শনিবার দুপুরে তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে সমাবেশ করেন বলেও জানান তিনি।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আবহাওয়াবিদ মো. মোস্তাফিজার রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর জেলায় ১৩২ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। রংপুর বিভাগসহ দেশের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে রংপুরের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব রহমান বলেন, ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। রংপুর অঞ্চলের নদ-নদীতে পানি বাড়া-কমায় কিছু স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দ্রুত ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কুড়িগ্রামে দুর্ভোগে দিন কাটছে পাঁচ উপজেলার বানভাসি প্রায় দেড় লাধিক মানুষের। বন্যা-কবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনো খবার সংকট। চারণ ভূমি তলিয়ে থাকায় গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বন্যাদুর্গতরা। গতকাল শনিবার সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার ও হাতিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রায় ৪০ কিলোমিটার দৈর্ঘের ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার চর, দ্বীপচরসহ নিম্নাঞ্চল। চরাঞ্চলের অনেক বাসিন্দা ঘর-বাড়ি ছেড়ে উঁচু এলাকায় ও আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করলেও অনেকেই রয়েছে ঘর-বাড়িতে। নিম্নাঞ্চলের কাচা-পাকা সড়ক তলিয়ে থাকায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। পানিতে তলিয়ে থাকায় বন্ধ রয়েছে চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলের শতাধিক প্রাথমিক ও মাধ্যামিক বিদ্যালয়। সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঝুনকার চরের খোদেজা বেগম বলেন, গত পাঁচ-ছয় দিন যাবৎ ঘরে পানি। বাড়িতে থাকার মতো অবস্থা না থাকার কারণে পাশের উঁচু একটি স্থানে ছেলেমেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিছি। স্বামী বাড়িতে নেই, কাজ করতে ঢাকা গেছেন। খাওয়া দাওয়ার খুব কষ্ট আমার।
সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, আমার ইউনিয়নটি ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদবেষ্টিত। ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষ পানিবন্দি। সরকারিভাবে অল্প কিছু ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি যদি বেসরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয় তাহলে অনেক মানুষ কষ্ট থেকে রেহাই পেতো। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার বলেন, বন্যাকবলিত জন্য ২৯১ টন চাল, ২০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও সাড়ে ১৫ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা বিতরণ চলছে। গত কয়েক দিন ধরে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ১২ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জের দুটি পয়েন্টে যমুনার পানি ৯ ও ৪ সেন্টিমিটার বেড়ে সিরাজগঞ্জ শহর ও কাজিপুর উভয় পয়েন্টেই বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া যমুনায় পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার সব নদ-নদীর পানি পাশাপাশি বিলের পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে। এতে প্রতিদিনই নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে বসত-বাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলি জমিতে পানি ওঠায় নষ্ট হচ্ছে কৃষকের শাকসবজি, বীজতলা ও রোপা আমন ধানসহ বিভিন্ন ফসল। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের অনেকেই। পাশাপাশি জেলার কয়েকটি অংশে যমুনার পাড়ে হয়েছে তীব্র ভাঙন।
গতকাল সকালে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জিত কুমার সরকার বলেন, সকাল ৬টায় সিরাজগঞ্জ শহর রা বাঁধ হার্ড পয়েন্টে যমুনা নদীর পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৪৮ মিটার। গত ১২ ঘণ্টায় ৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপদসীমা ১২ দশমিক ৯০ মিটার)। অপরদিকে, কাজিপুরের মেঘাই ঘাট পয়েন্টে পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৫ দশমিক ৩৮ মিটার। এই পয়েন্টে গত ১২ ঘণ্টায় ৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপদসীমা ১৪.৮০ মিটার)।
রঞ্জিত কুমার সরকার বলেন, পানি বাড়লেও এই মুহূর্তে ভারী বন্যার আশঙ্কা নেই। আগামী ৮ জুলাই পর্যন্ত যমুনার পানি বাড়তে পারে। এ সময়ে পানি বেড়ে বিপদসীমার ৮০ সে.মি ওপর পর্যন্ত যেতে পারে। তবে পরবর্তীতে তিন-চার দিনের মধ্যে পানি নেমে যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন রোধে পাঁচ হাজার জিও ব্যাগের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যদিও আগে থেকেই জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান বলেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, রংপুর, জামালপুর, গাইবান্ধা, ফেনী, রাঙ্গামাটি, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট ও কক্সবাজার জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। বন্যা কবলিত ১৫ জেলায় এ পর্যন্ত নগদ তিন কোটি ১০ লাখ টাকা, ৮ হাজার ৭০০ টন ত্রাণের চাল, ৫৮ হাজার ৫০০ বস্তা শুকনো খাবারের ব্যাগ ও অন্যান্য খাবার, শিশুখাদ্য কেনার জন্য ৬০ লাখ টাকা এবং গো-খাদ্য কেনার জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনই বন্যা বিস্তৃতি লাভ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। পুরো ১৫ জেলায় মানুষ পানিবন্দি নয়। কোনো কোনো জেলা আংশিকভাবে বন্যা কবলিত। এখন পর্যন্ত আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৬ হাজার ২২৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বন্যায় এখন পর্যন্ত তিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। কেউ মারা যায়নি। এর মধ্যেই পানিবন্দি মানুষ রয়েছে। প্রতিদিনই মানুষ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। বন্যা-আক্রান্ত অঞ্চল নিয়ে সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বন্যা ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃতি লাভ করলে সেই জায়গাগুলোকেও আমরা অ্যাড্রেস করব। বন্যার কারণে দণি দিকেও প্লাবিত হতে পারে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামী মাস (আগস্ট) কিংবা তার পরের মাসেও (সেপ্টেম্বর) এ রকম আরেকটি বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী বন্যার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। সবার সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা কাজ করছি। তারপরও বিভিন্ন সময় পত্রিকায় দেখি যে, কোনো কোনো জায়গায় খাদ্য পায়নি। এ জন্য আমরা জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব। ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্য, ডিসি, ইউএনও যখন যেটা চাচ্ছেন আমরা দিচ্ছি। তারপরও গ্যাপ থাকার কোনো কারণ নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মনে করি বন্যাদুর্গত এলাকায় যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত।