
* সারাদেশে অভিযানে নেমেছে যৌথ বাহিনী
* টার্গেট আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা
* আইনের আওতায় আনা হবে সন্ত্রাসীদের
* গাজীপুরের ঘটনায় জড়িতদের সাজা নিশ্চিত করা হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
* শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনায় ওসি প্রত্যাহার
* জিএমপি কমিশনারের দুঃখ প্রকাশ
সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে গতকাল শনিবার থেকে শুরু হয়েছে অপারেশন ডেভিল হান্ট। গত শুক্রবার রাতে গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও ১৫ জন আহত হওয়ার ঘটনার পর অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে এই অভিযান শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। গতকাল শনিবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে এক সভায় অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে এই অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়াও গাজীপুরে হামলার ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তবে গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার নাজমুল করিম খান।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় থানা ও পুলিশ ফাঁড়িসহ পুলিশের বেশ কিছু স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসময় লুট হয় পুলিশের কয়েক হাজার অস্ত্র ও কয়েক লাখ গোলাবারুদ। এসব অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবার জন্য হুমকিস্বরূপ। এজন্য অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গতকাল শনিবার থেকে শুরু হয়েছে যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত অপারেশন ডেভিল হান্ট। গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর আগে গত শুক্রবার রাতে গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর হয়। সেখানে পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। তাদের হামলায় ১৫ জন আহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অপারেশন ডেভিল হান্ট নামের অভিযান গতকাল শনিবার থেকেই গাজীপুর এলাকাসহ সারাদেশে শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গতকাল শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফয়সল হাসানের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এই অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় গতকাল শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। গতকাল শনিবারে অপারেশন ডেভিল হান্টের অভিযানের বিষয়ে আজ রোববার সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হবে।
গাজীপুরে হামলার ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা হবে বলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর আশ্বাসের কয়েক ঘণ্টা পরই অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। গতকাল শনিবার বেলা ১২ টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে গিয়ে ওই আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। গত শুক্রবার রাত ৯টার দিকে গাজীপুর নগরের ধীরাশ্রম দাক্ষিণখান এলাকায় সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়ি ভাঙচুরের খবর পেয়ে ঠেকাতে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন। পরে সেখানে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে স্থানীয়রা তাদের ওপর হামলা চালায়। ওই ঘটনায় ১৫ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের এডিসি (উত্তর) রবিউল ইসলাম।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গাজীপুরের নেতাকর্মীরা বলেছেন, হামলায় আহতদের সবাইকেই প্রথমে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে গত শুক্রবার রাত একটার দিকে গুরুতর আহত সাত জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওই হামলার প্রতিবাদে গতকাল শনিবার দুপুরে জাতীয় নাগরিক কমিটি গাজীপুর জেলা ও মহানগর শাখার আয়োজনে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে নগরের ভাওয়াল রাজবাড়ি সড়ক অবরোধ করেন নেতাকর্মীরা। এ সময় আন্দোলনকারীরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের গ্রেফতারের দাবি এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন।
গত শুক্রবার রাতের এই হামলার প্রতিবাদে গতকাল শনিবার দুপুরে গাজীপুর জেলা শহরের রাজবাড়ী মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই সমাবেশে যোগ দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম হামলায় জড়িত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে কারাগারে না পাঠানো পর্যন্ত রাজপথে অবস্থানের ঘোষণা দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম আরও বলেন, খুনি হাসিনার আওয়ামী লীগ, যুবলীগও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এখনো গাজীপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সন্ত্রাসীরা এখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের যোদ্ধাদের হুমকি দিচ্ছে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ইন্টেলিজেন্স যদি আজকে রাতের মধ্যে গত শুক্রবার রাতের হামলায় জড়িত খুনি সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে না পারে তাহলে আমাদেরকে তাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের কোথাও আমাদের কোনো সহযোদ্ধার গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করলে পুরো বাংলাদেশ আবার নতুন করে জেগে উঠবে। আমরা প্রয়োজনে যেমন ঢাকায় নামতে পারি, যেমন গাজীপুরে আসতে পারি, আমরা প্রয়োজনে দেশের প্রত্যেকটি জেলায় জেলায় যেতে পারি। আমরা অভ্যুত্থানে দেখিয়েছি, এদেশের ছাত্র-জনতা সঠিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ধৈর্য ধরেছে। কিন্তু একটা ধৈর্যের বাঁধ আছে। এই দেশে প্রশাসন থেকে শুরু করে যারা কাজ করছে তারা যদি আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলে তাহলে দেশে নতুন আরেকটি বিপ্লব দেখতে হবে। অপরদিকে গতকাল শনিবার বিকেলে গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে রাজবাড়ী সড়কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গিয়ে পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান ওসিকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। এরপর ওসি আরিফুল ইসলামকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম-অপস) তাহেরুল হক চৌহান।
জিএমপি কমিশনার নাজমুল করিম খান বলেন, গত শুক্রবার রাতে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তাতে পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমি ব্যর্থতা স্বীকার করে নিচ্ছি। হামলাকারী কাউকে ছাড়া হবে না, প্রতিটি হামলার জবাব দেয়া হবে। যেসব পুলিশ রেসপন্স করতে দেরি করেছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। তিনি আরও বলেন, আমি শুনেছি, আমার ওসি দুই ঘণ্টা পর আপনাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। আমি এখানে দাঁড়িয়ে বললাম, তাকে সাসপেন্ড (বরখাস্ত) করব। আমি বলতে চাই, যারা এই ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আঁতাত করেছে, তাদের পুলিশে চাকরি করতে দেওয়া যাবে না। পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, গত ১৭ বছর ধরে যারা অত্যাচার করেছে, দেশের ওপর জুলুম করেছে, তারা মাথাচাড়া দিচ্ছে। কিন্তু তাদের কোনো মাথাচাড়া বরদাশত করা হবে না। ইতোমধ্যে ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল শনিবার রাতে চিরুনি অভিযান চালানো হয়েছে। ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ দমন করার জন্য অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যের সময় সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলমসহ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।