
১৮৬০ সালে ইংরেজরা দুটি অস্থায়ী কাঠের জেটি দিয়ে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দর। কালের বিবর্তনে সেটি এখন দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, যাকে বলা হয় অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। এত বছর পরে এসেও সেবার মান নিয়ে আছে প্রশ্ন। দেশের অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করতে সেবার সমন্বয় ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক বন্দর চান ব্যবসায়ীরা।
বন্দর সংশ্লিষ্ট অনেকের দাবি, সক্ষমতার চেয়েও এগিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। তবে ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, বন্দরের সেবায় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একদিকে কম সময়ে অধিকতর ভালো সেবার পাশাপাশি আগামীর প্রযুক্তিনির্ভর বন্দর চান ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর ও বে-টার্মিনাল দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি তাদের।
দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ কার্যক্রম সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বাংলাদেশে সমুদ্রপথে পরিবহন করা কনটেইনারের ৯৮ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবাহিত হয়। আমদানি-রফতানি পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। আবার রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে।
চট্টগ্রাম বন্দরের দেয়া তথ্যে জানা যায়, চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছর শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগেই কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে গত বছরকে ছাড়িয়ে গেছে চট্টগ্রাম বন্দর। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের পুরো সময়ে ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করলেও চলতি অর্থবছরের ১৫ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৭৭৯ টিইইউ।
এদিকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১২ কোটি ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৭৪৮ টন কার্গো, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৭৫ টিইইউ কনটেইনার, ১১ কোটি ৮২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ মেট্রিক টন কার্গো, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউ কনটেইনার, ১১ কোটি ৮১ লাখ ৭৪ হাজার ১৬০ টন কার্গো, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৩০ লাখ ৯৭ হাজার ২৩৬ টিইইউ কনটেইনার এবং ১১ কোটি ৩৭ লাখ ২৯ হাজার ৩৭৩ টন কার্গো হ্যান্ডলিং করেছে চট্টগ্রাম বন্দর।
বাংলাদেশ নন-প্যাকার্স ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আমদানিকারক মাহবুব রানা বলেন, এখন বলা হচ্ছে বন্দর সক্ষমতার বেশি কাজ করছে। এটি কীভাবে সম্ভব? লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কথা বলা হচ্ছে। মানে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়ানো যাবে। বোঝা যাচ্ছে, বন্দরের সক্ষমতা নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় ভুল রয়েছে। বেসরকারি ডিপোগুলোকে বেশিরভাগ আমদানিপণ্য ডেলিভারি দেয়ার জন্য দেয়া হয়েছে। বন্দর অভ্যন্তরের গতিশীলতা বাড়ানোর জন্য এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। তারপরেও বন্দরের কার্যক্রম অনেক সময় বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশি-বিদেশি একটি শক্তি চট্টগ্রাম বন্দরকে গুরুত্বহীন করার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, তাছাড়া বন্দরের কার্যক্রমেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। বিশেষ করে লালদিয়া মাল্টিপারপাস কনটেইনার টার্মিনাল করার কথা ছিল, এখনো হয়নি। বে-টার্মিনাল, মাতারবাড়ি এগুলো আরও আগেই অপারেশনে আসার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল বন্দর। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বন্দরের সময়জ্ঞানের অভাবে এগুলোর এখনো নির্মাণ শুরু করা সম্ভব হয়নি। তাই চলমান পরিকল্পনা ও কার্যক্রমগুলো নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করার পদক্ষেপ নিতে হবে বন্দরকে। চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবকাঠামোতে কর্মদক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ তেমনটি নেই মনে করছেন বন্দর অপারেটররা। যে কারণে দ্রুততম সময়ে নতুন বন্দর হিসেবে মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর নির্মাণের তাগিদ বন্দর ব্যবহারকারীদের।
বন্দরের বার্থ অপারেটর এভারেস্ট পোর্ট সার্ভিস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, বন্দরের বর্তমান যে সক্ষমতা, তার সর্বোচ্চ উজাড় করে দিয়ে কাজ চলছে। সব পক্ষই আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করছে। বর্তমান বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর আর সুযোগ নেই। ইচ্ছা করলেই আর বড় জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ঢোকানো সম্ভব হবে না। চাইলেও বর্তমান গভীরতাকে আর বাড়ানো যাবে না। তিনি বলেন, এ সীমাবদ্ধতা নিয়েই কাজ করতে হবে। তবে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের আরও ৫-৭ বছর আগেই আধুনিক একটি সমুদ্রবন্দর করা প্রয়োজন ছিল, যার ড্রাফট ১২ মিটারের বেশি। তারপরেও বর্তমান মাতারবাড়ি কিংবা বে-টার্মিনালের কাজে যাতে আর কোনো বিলম্ব করা না হয়। সক্ষমতা নির্ভর করে পণ্য আমদানি-রফতানির ওপর। পোশাক শিল্পের প্রবৃদ্ধির ওপরও অনেকটা নির্ভর করে। আমাদের বর্তমানে বছরে ৯ লাখ টিইইউ কনটেইনার খালি চলে যায়। আমাদের রফতানি সক্ষমতা বাড়লে এসব কনটেইনার খালি পাঠাতে হতো না বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহ-সভাপতি খায়রুল কবির সুজন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর শত বছরের বেশি পুরোনো বন্দর। বন্দরের যে স্থাপনা তাতে নতুন কোনো অবকাঠামো তৈরির সুযোগ নেই। জিসিবিগুলোতে গ্যান্ট্রি ক্রেন সংযোজনের সুযোগও নেই। তাই আমাদের নতুন একটি বন্দর প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমাদের একটি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বন্দর প্রয়োজন। যেটি হবে বিশ্বমানের, যেখানে থাকবে বিশ্বমানের ইক্যুপমেন্ট। এখন নতুন নতুন জাহাজ তৈরি হচ্ছে। এসব জাহাজ হ্যান্ডেলের মতো করেই বন্দর তৈরি করতে হবে। এজন্য নতুন যে মাতারবাড়ি বন্দরের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বন্দর, তাতে যাতে বিষয়গুলোর প্রতিফলন ঘটে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন করা হয়।
এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের (আইবিএফবি) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের চেয়ারপারসন এবং তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ পরিচালক এসএম আবু তৈয়ব বলেন, বন্দর অনেক সময় সক্ষমতার বাইরে গিয়েও পারফর্ম করছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেভাবে উপকৃত হচ্ছেন না। কারণ, বন্দর সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি ছুটি, দাবি-দাওয়া নিয়ে নানান সংগঠনের কর্মসূচির কারণে বন্দরের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, বন্দরে কনটেইনারের জটলা তৈরি হয়। কিন্তু এই আপদকালীন সময়টা কাজে লাগানোর জন্য বন্দরের কোনো পরিকল্পনা নেই। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই সময়টি ব্যবস্থাপনার জন্য আমদানিকারক, রফতানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, শিপিং কোম্পানি, ব্যাংক, বিমা থেকে শুরু করে সব স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে সিদ্ধান্ত নেয়া গেলে সবাই উপকৃত হবে, বন্দরও আরও বেশি গতিশীল হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল চালু রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে (এনসিটি) পাঁচটি জাহাজ বার্থিং করা যায়। পাশের চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) তিনটি জাহাজ বার্থিয়ের সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে পুরোনো জেনারেল কার্গো বার্থ (জেসিবি) হিসেবে ১৩টি জেটি রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর অভ্যন্তরে। গত বছর বন্দরের মোট কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ এনসিটি, ১৯ শতাংশ সিসিটি এবং ৩৭ শতাংশ কনটেইনার জেসিবিতে হ্যান্ডলিং হয়েছে। বন্দরের অর্থায়নে নতুন নির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) অপারেশনের জন্য গত বছর জুন থেকে সৌদি প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালকে দেয়া হয়। এখনো পুরোদমে চালু হয়নি টার্মিনালটি। এনসিটি টার্মিনালটিতে বার্ষিক ১০ লাখ টিইইউ কনটেইনার জাহাজে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সক্ষমতা থাকলেও গত বছর ২০২৪ সালে ১২ লাখ ৮১ হাজার টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়।